• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হামাকেরে কাম-কাজ নাই ৪মাস থাকা, অ্যাকন কি দিয়া দিন পার করমু?

  কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ

২১ জুলাই ২০২০, ০৯:৫২
নওগাঁ
অভাব তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নওগাঁ জেলার প্রায় ৯শ ডেকোরেটর শ্রমিক

হামাকেরে কাম-কাজ নাই চার মাস থ্যাকা। অ্যাক বেল খাওছি আর অ্যাক বেল না খ্যায়া থাকোছি। বাড়িত অসুকের উগি চিগিস্বা হছে না। অ্যাকবার পাঁচ কিজি চাউল-ড্যাল পাছনু ডিসি অপিসোত থ্যাকা। অ্যাকন কি দিয়া দিন পার করমু? কথা গুলো বলতে গিয়ে দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল ডেকোরেটর শ্রমিক নজরুল ইসলামের।

একদিকে দু’বেলা খাবার জোটেনা তার উপর অসুস্থ স্ত্রী মাসুমা খাতুন ও মা নূরবানু (৬৫) কে নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে আইভীর পড়াশোনাও প্রায় বন্ধের পথে। নজরুল ইসলাম জানান, ২ বছর আগে যুবলীগের সম্মেলনের মঞ্চ সাজাতে গিয়ে বাঁশের উপর থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও ডান পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। সেরে ওঠার পর প্রতিদিন তার নিজের জন্য ৫০/- টাকার ঔষধ কিনে খেতে হয়। এখন ঔষধ তো দূরের কথা পরিবারে জন্য দু’বেলা খাবার তিনি যোগান দিতে পারছেন না।

এমনই অভাব তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নওগাঁ জেলার প্রায় ৯শ ডেকোরেটর শ্রমিক। বাধ্য হয়ে কেউ রাজমিস্ত্রির সহকারী, কেই রিক্সা ভ্যান চালিয়ে, কেউ ঘুড়ি তৈরি করে আবার কেউ সামান্য পুঁজি দিয়ে আম-লিচুর অথবা তরিতরকারির ব্যবসা করছেন। এইসব ব্যবসার অভিজ্ঞতা না থাকায় লোকসান গুনে সামান্য জমানো পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তবে তরিতরকারির ব্যবসা চললেও মৌসুম শেষ দিকে লিচু-আমের ব্যবসা এখন বন্ধের পথে। আবার কেউ পরিবারের চোখ এড়িয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে কোন ভাবে দুবেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড়ে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখন মহামারি করোনায় সীমিত হয়ে আসছে সকল শ্রমের পরিধি।

রিক্সাভ্যান চালক নূরুল ইসলাম ডেকোরেটর দোকানের মালামাল বহন করেন। সংসারে তাঁর স্ত্রী ও ২ ছেলে ১ মেয়ে। নূরুল ইসলাম শহরের গোস্তহাটির মোড়ের লতিফ ডেকোরেটরের ভ্যান চালায়। করোনার আগে ডেকোরেটর থেকে যা আয় হোত তা দিয়ে ভালই চলছিল তার সংসার। তার স্ত্রী বিলকিস বেগম কিডনি রুগী। প্রতিদিন তার জন্য ১১০/- টাকার ঔষধ কিনতে হয়। এছাড়া সংসার খরচ প্রতিদিন আরো ২০০/- টাকা। এখন সব রোজগার বন্ধ তাঁর। স্ত্রীর জন্য নিয়মিত ঔষধ কিনতে পারছেনা তিনি। তাই বাধ্য হয়ে ডেকোরেটরের রিক্সাভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন ভাড়া পাওয়ার আশায় গোস্তহাটীর মোড়ে। মাঝে মধ্যে ভাড়া পেলেও তা দিয়ে সংসার চলছেনা তার। সন্তান আর রুগ্ন স্ত্রীকে নিয়ে কোন কোন দিন অভুক্ত থাকতে হচ্ছে তাকে।

আশরাফুল ডেকোরেটর শ্রমিক। বড় ছেলে জান্নাতুল নাইম নওগাঁ সরকারী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ৩য় বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে হামিম রাসু এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। আশরাফুলে স্ত্রী শাহানাজ বেগম অসুস্থ। তাঁর জন্য ঔষধ কেনার মত টাকা নাই আশরাফুলে কাছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই দুই ছেলে সবসময় থাকছে বাড়িতে। ছেলেদের কি খেতে দিবে আর স্ত্রীর জন্য কিভাবে ঔষধ কিনবে তা সে জানেনা। আম কিনে ব্যবসা করতে গিয়ে সামান্য যা পুঁজি ছিলো তা আমের ডালিতেই ফেলে দিতে হয়েছে। সেখান থেকে লাভ তো হয়নি মূলধন হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। অন্য কোন কাজও জানা নাই তার যে কাজ করে তিনি সংসারের খরচ চালাবেন।

নওগাঁ জেলা ডেকোরেটর মালিক কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি ও লতিফ ডেকোরেটরের কর্ণধার মোঃ সোলায়মান তালুকদার টিপু বলেন, নওগাঁ জেলা সদরে ৪০টিসহ জেলার ১১টি উপজেলায় ৩২০ জন ডেকোরেটর মালিক রয়েছেন। করোনার কারণে গত ২০ মার্চ থেকে ডেকোরেটর মালিকদের ব্যবসা একবারে বন্ধ হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় এই ব্যবসা সংশ্লিষ্ট মালিক, শ্রমিক, বাবুর্চি, ভ্যান শ্রমিক সকলেই পড়েছেন চরম বিপাকে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার জন্য ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করেছি। ব্যাংকের ম্যানেজার বলেছেন আপনি কি আমাদের ব্যাংকে বছরে ১০/২০ লাখ টাকা লেনদেন করেন। আমি বলেছি মফস্বল শহরের ডেকোরেশনের ব্যবসা করে এতো টাকা লেনদেন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। ওই ব্যাংকের ম্যানেজার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তা হলে আপনি প্রণোদনার সুযোগও পাবেননা। এই তো হলো প্রণোদনার অবস্থা। আমরা তো হাত পেতে সাহায্য নিতে পারছিনা, আবার ত্রাণও নিতে পারছিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা না করেন তবে ডেকোরেটরের হাড়ি-পাতিল, চেয়ার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় সামনে দেখতে পাচ্ছিনা।

জেলা ডেকোরেটর মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি রাশেদুল আলামিন রন্টু বলেন, আমি গত ১৫ জুন আমাদের ডেকোরেটর ব্যবসায়ীদের সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রণোদনা ও সাহায্যের জন্য নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবর সমিতির পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন করেছিলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত কোন সারা পাওয়া যায়নি।

ডেকোরেটর মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে অনেক ডেকোরেটর মালিক তাঁদের স্ট্যান্ড ফ্যান বিক্রি করে দোকান ও গুদামের ভাড়া পরিশোধ করেছেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কমদামে পেয়ে অনেকেই কিনেছেন সেই সব ফ্যান। যখন সব কিছু স্বাভাবিক ছিল তখন গরীব পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শুধু খরচের টাকা নিয়ে তারা সহযোগিতা করেছে। কোন কোন সময় তাও নেয়া হতো না। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে তাঁদের সংসার চালানো ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাতে গিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।

নওগাঁ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল বলেন, চেম্বার থেকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে মত বিনিময় করা হয়েছিল। সেখান ডেকোরেটর মালিকরা উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ব্যাংক থেকে তাঁদের সাথে কি কথা হয়েছে সে বিষয়ে তাঁরা আর যোগাযোগ করেনি। ডেকোরেটর মালিকদের জন্য চেম্বার থেকে কিছু করার নাই। তবে এই সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের জন্য সাহায্য সহযোগিতার ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ডেকোরেটর শ্রমিকদের মাঝে কিছু খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছি। আরও দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ডেকোরেটর মালিকদের মধ্যে যদি কেউ বেশী সমস্যায় পড়েন তবে বিশেষ ভাবে তাঁদের সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ডেকোরেটর মালিকরা পাবেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, ব্যাংকের কিছু নীতিমালা রয়েছে তার ভিত্তিতে ঋণ প্রদানের বিষয়টি নির্ভর করে। তবে ডেকোরেটর মালিকদের অন্যকোন ভাবে যাতে সাহায্য সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করা হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড