• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাগর পথে রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত যাত্রায় নিহত ১৫, জীবিত উদ্ধার ৭১ 

  শাহ মুহাম্মদ রুবেল, কক্সবাজার

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:০৮
কক্সবাজারে পাচার
কক্সবাজারে পাচার হতে যাওয়া একটি ট্রলার ডুবে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। জীবিত উদ্ধার হয় ৭১ জন। (ছবি : দৈনিক অধিকার)

বৈধ পথ বন্ধ থাকায় অবৈধ পথে ফের শুরু হয়েছে মানবপাচার। মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সকালে কক্সবাজারে পাচার হতে যাওয়া এমন একটি ট্রলার ডুবে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। জীবিত উদ্ধার হয় ৭১ জন। মৃতদের মধ্যে ১২ জন নারী ও ৩ জন শিশু। আর জীবিতদের মধ্যে ৪৬ জন নারী, ৪ জন শিশু ও ২১ জন পুরুষ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ট্রলারে ১৩৮ জন যাত্রী ছিলেন। এদের সকলেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।

ঘটনাটি ঘটে সেন্টমার্টিন থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে। পুলিশ এ ঘটনায় ৪ পাচারকারীকে আটক করেছে। জড়িত বাকিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

আটক হওয়া চারজন হচ্ছেন- টেকনাফ বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ার ফয়েজ আহম্মদ (৪৮), টেকনাফ সদরের সৈয়দ আলম (২৭), উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আজিম (৩০) ও বালুখালীর ওসমান (১৭)।

বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানায়, রোহিঙ্গাদের একটি বড় দল অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় সোমবার গভীর রাতে টেকনাফের নোয়াখালীয়াপাড়া থেকে মাছ ধরার দুটি ট্রলারে চেপে রওনা হয়। মঙ্গলবার সকালে একটি ট্রলার দুর্ঘটনায় পড়ে সাগরে ডুবে যায়।

খবর পেয়ে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের কোস্টগার্ড উদ্ধার কাজ শুরু করে। এই উদ্ধার কাজে কোস্টগার্ডের মেটালসার্ক, একটি কাটের ও ৮ টি স্পিড বোট কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে। এখনো নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। উদ্ধার লাশ ও জীবিতসহ আটক পাচারকারীদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কোস্টগার্ড।

উদ্ধার হওয়া বালুখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. জুবাইর জানায়, রহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আমাদের নিয়ে আসে টেকনাফ বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ার সৈয়দ আলম ও নুরুল আলম। তারা আমাদের একদিন পাশের জুমপাড়া পাহাড়ে রাখে। পরে সোমবার রাতে একটি ট্রলারে ১৩৮ জনকে তুলে দেয়। মঙ্গলবার সকালে দুর্ঘটনার পর কে কোথায় চলে যায়। তবে, এ ঘটনাটি সকালের দিকে হওয়ায় অনেক প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। রাতের বেলায় হলে মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

তিনি বলেন, পরিবারের কথা চিন্তা করে, উন্নত জীবনের আশায় এ পথে যেতে চাইলাম মালয়েশিয়া, কিন্তু যেতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যেত।

উদ্ধার হওয়া নারীদের মধ্যে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, তাদের মিয়ানমারের রাখাইনে বাড়ি ঘর ও পরিবার পরিজন নিয়ে খুব ভালো ছিল। সেই সব ঘরবাড়ি রেখে এখন ঠাঁই হয়েছে উখিয়ায় পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে। এনজিও দেওয়া ত্রাণে চলছে পরিবার।

তিনি বলেন, তার এক ভাই মালয়েশিয়া রয়েছে। তার কথা মতো দালালের সাথে যোগাযোগ করে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। কিন্তু মালয়েশিয়া স্বপ্ন পূরণ দূরে থাক আল্লাহ প্রাণে রক্ষা করেছেন।

সমুদ্রপথে মানবপাচারকারী চক্র এবার পাচারের জন্য রোহিঙ্গা শিবিরকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। এসব পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গাদেরই একটি দালাল চক্র।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্বিচারে গণহত্যা ও নির্যাতনের কারণে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এছাড়া আগে থেকেই বাংলাদেশে চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফে অশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১২ লাখের মতো, যারা কর্মহীন দিন কাটাচ্ছে।

এসব আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে পাচারকারী চক্রগুলো আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে। এই পাচারের সঙ্গে যুক্ত আবার রোহিঙ্গাদেরই একটি অংশ। এরই মধ্যে সমুদ্রপথে পাচারকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা দালাল।

তাদের দেওয়া তথ্যমতে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবপাচারকারী চক্রের অনেক সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে, হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোসেন, মোহাম্মদ রশিদ, হাসিম উল্লাহ, মোহাম্মদ শাহ ও মোহাম্মদ হামিদ। তারা সবাই উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।

এর আগে গত ২০ জানুয়ারী টেকনাফ বাহারছড়া উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া পাচারকালে ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। তার মধ্যে ১৮ নারী, ১ শিশু ও ৩ পুরুষ ছিল। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এর কয়েকদিন আগে উখিয়া-টেকনাফ উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া পাচারকালে ৭০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৮ জন নারী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে। এতে চার দালালকে আটক করা হয়। তারা হলেন- টেকনাফের মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ, মো. হুমায়ুন, মো. মামুন ও উখিয়ার আব্দুল কাদের।

২০১০ সালে টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাগরপথে মানবপাচার শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের পর থেকে পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে কয়েক লাখ বাংলাদেশি ও মিয়ানমার নাগরিক মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়। মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়া অনেকেই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা যান। আবার সে সময় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়।

আরও পড়ুন : দেশ ইতিহাসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে : খালিদ মাহমুদ

পরবর্তীতে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবরের সন্ধানের পর আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। তখন সাগরপথে মানবপাচার বন্ধে ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসন। ওই সময় টেকনাফে পুলিশ ও মানবপাচারকারীর মধ্যে বন্ধুকযুদ্ধে টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপের ধুলু হোসন, সাবরাং কাটাবনিয়ার জাহাঙ্গীর আলম ও হারিয়াখালীর জাফর আলম নিহত হয়েছিল। এর পর থেকে মানবপাচারকারীদের মধ্যে টনক নড়ে। পরবর্তীতে চিহ্নিত মানবপাচারকারীরা চলে যায় আত্মগোপনে। কমে আসে উপকূল দিয়ে মানবপাচার।

ওডি/এএইচ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড