• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

টুং-টাং শব্দে তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের গহনা

  আরিফুর রহমান, সাভার

০১ আগস্ট ২০১৮, ১৮:০৫
ছবি : দৈনিক অধিকার

সাভারে এক সময়কার অবহেলিত জনপদের নাম ভাকুর্তা। লেখাপড়ার দিক দিয়ে তারা পিছিয়ে ছিল। বেকার জীবনযাপনে দিন কেটে যেত অনেকের। কেউ কেউ বেপরোয়া চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন। এ জনপদে আজ আর কেউ বেকার ঘরে বসে নেই। ছোট-বড় নারী পুরুষ অনেকেই ব্যস্ত তামা ও পিতল দিয়ে গহনা তৈরিতে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুনসান শব্দে নানা প্রকার গহনা তৈরিই তাদের পেশা। তাদের ভেতর ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। তারা আধুনিক এ সমাজের উদাহরণ হয়ে দাড়িছেন। রাজধানী শহরের গা ঘেঁষে মোহাম্মদপুর, আদাবর বেড়িবাঁধের ওপারে তুরাগ নদী পেরিয়ে যে জনপদ তার নাম ভাকুর্তা। সাভার উপজেলার একটি ইউনিয়ন ভাকুর্তা। এ ইউনিয়নে রয়েছে ৩০টি গ্রাম।

গ্রামগুলোতে বসবাস করা মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস গহনা তৈরি করা। নারী-পুরুষ মিলে মেয়েদের গহনা তৈরি করেন। যেগুলো বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। গহনার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সোনা-রুপার তৈরি নারীদের পরিধান যোগ্য বিভিন্ন গহনা।

কিন্তু স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে সাভারের ভাকুর্তা বাজার ও এর আশেপাশের গ্রামগুলোতে গহনা তৈরি করা হয় তামা ও পিতল দিয়ে। প্রাথমিকভাবে এগুলো অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রং করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। যা সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত। এগুলো দেখতেও যেন সোনার মত তা সবার জানা। এখানে তামার ব্যবহারটা বেশি হলেও পিতল ও দস্তা দিয়েও গহনা তৈরি করেন কারিগররা।

এখানকার কারিগররা বেশিরভাগ সোনা ও রুপার দোকানে কাজ করে বিভিন্ন ডিজাইনের কৌশল রপ্ত করেছেন। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গহনাও তৈরি করে দেন তারা।

ভাকুর্তা বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু পাকা, আবার কিছু আধা-পাকা, কিছু টিনের ঘর। এর মধ্যে বসে দিব্যি কাজ করছেন বিভিন্ন বয়সী কারিগর ও তাদের সহকারীরা। কারিগররা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তৈরি করছেন গলা, নাক, কান, পা, কোমর, মাথার বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা। সোনার দোকানে যে সকল জিনিস থাকে তার যেন সবই রয়েছে ঘরগুলোতে। সামনে, পিছনে, দেয়ালে থরে থরে সাজানো মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের গহনা।

আমেনা জুয়েলারি ওয়ার্কশপের মালিক মো. সাদেক মিয়া জানান, গহনা তৈরির কাজটি আগে হিন্দুরা করতেন। মুসলমানরাও এটাকে এখন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

তিনি আরও জানান, তাদের তৈরি গহনাগুলো পাইকারিদের কাছে বিক্রি করা ২০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। দাম ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে। যেমন গলার নেকলেস ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চুরি ২ শত থেকে ৩০০ টাকা জোড়া, শিতাহার ৬০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার ঝাপটা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মালতাশা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, খোপার কাটা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার টায়রা ৩০০-৪০০ টাকা, শাড়ির মালা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, কপালের টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা।

এগুলো সব অপরিশোধিত অবস্থায় বিক্রি হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে পরিশোধন করে যখন মার্কেটে খুচরা বিক্রি করেন তখন এর দাম দেড় থেকে দুইগুণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় বলে জানান সাদেক মিয়া।

ভাকুর্তা বাজারের কারিগর বেচারাম দেওরি জানান, গহনা তৈরির কাঁচামাল তামা কিনে নিয়ে আসা হয় ঢাকার কোতোয়ালি থানার তাঁতিবাজার থেকে। দাম পড়ে কেজি প্রতি ১ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া কিছু গহনার কাঁচামাল বগুড়া ও ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়।

নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করেন কারিগররা। দিনে ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করে আয় হয় মাত্র ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা।

ভাকুর্তা বাজারের স্বর্ণ, রোপ্য ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান,ভাকুর্তা বাজারের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। এ বাজারে দোকান রয়েছে ১৩০ টির মতো। আর ভাকুর্তা ইউনিয়নে কমপক্ষে ২৫০-৩০০ টি দোকান। ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য এই পেশায় জড়িত রয়েছেন।

৮০ দশকেও এই বাজারে সোনা ও রুপার গহনা তৈরি হত। কিন্তু এগুলোর দাম বাড়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও কারিগররা সোনা ও রুপার অলংকার তৈরি থেকে সরে আসেন। ৯০’র দশকে এসে ঝুঁকে পড়েন ইমিটেশনের গহনা তৈরির দিকে।

তিনি বলেন, ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে সব ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের গহনা বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই এখানে তৈরি হয়। এছাড়া স্বল্প সংখ্যক মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, ইতালিতেও রপ্তানি করা হয়। এরপরও আমাদের আয় অনেক কম। সরকার যদি আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের অবস্থা আরও উন্নত হত।

তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় বড় শপিং মল, ঢাকার নিউমার্কেট, আজিজ সুপার, চাঁদনীচকসহ সব মার্কেটের গহনা আসে ভাকুর্তা থেকে। মার্কেটগুলোতে সিটি গোল্ড বা এন্টিক নামে এসব গহনা বিক্রি হয়। শুধু দেশে নয়, এখানকার গহনার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও।

একাধিক মালিক ও কারিগররা জানিয়েছেন-তামা, পিতল দিয়ে এসব গয়না তৈরি হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চমূল্যের কারণে এসব গহনাই এখন বেশি চলছে। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মেয়েরা এসব গহনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ভাকুর্তার কারখানাগুলোতে হাজারো নকশার গহনা পাওয়া যায়। চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়েও গহনা তৈরি করানো যায় এখানে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড