• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কৃষকের লটারিতে চেয়ারম্যানের স্ত্রী-সন্তানদের নাম

  হূমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম

১০ জানুয়ারি ২০২০, ২২:২৯
অভিযোগের কপি
অভিযোগপত্রের কপি (ছবি : দৈনিক অধিকার)

সারা দেশে লটারির মাধ্যমে কৃষকদের জন্য সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রয়ের সুবিধা দিয়েছে সরকার। কিন্তু কুড়িগ্রামে কৃষকদের বঞ্চিত করে একটি চক্র কৃষি কার্ড ক্রয় করে ধান বিক্রি করছে খাদ্যগুদামে। এছাড়া হলোখানা ইউনিয়নে লটারি না করেই ওই ইউপি চেয়ারম্যানসহ তার স্ত্রী-সন্তান, স্বজন ও পরিষদের ১১ সদস্যের নামে কার্ড করা হয়েছে। বাদ যায়নি জেলা খাদ্যগুদাম কর্মচারীর নামও। এছাড়া যাদের ফসলি জমি নেই; এমন লোকজনকেও কৃষিকার্ড দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে প্রচার-প্রচারণাসহ জনসম্মুখে তালিকা প্রকাশ করে লটারির কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। প্রকৃত কৃষকদেরও দেওয়া হয়নি কৃষি কার্ড। প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের আড়াল করতে নামকাওয়াস্তে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে তালিকা। সেই তালিকায় হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক (১৩৯), স্ত্রী স্মৃতি (৭০), ছেলে রাজ্জাক রাজু (১০১) ও রেজাউল করিম (৯০), ভাই হাসেন আলী (১৩৯) এবং ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্যসহ ১১ জন কমিশনারের নাম রয়েছে।

এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ফসলি জমিন নেই এমন লোকদের নামও তালিকায় রয়েছে। এ অবস্থায় ইউনিয়নের অনেক নামধারী কৃষকদের কৃষি কার্ড কিনে নিয়ে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করছে একটি চক্র। প্রকৃত কৃষকরা তালিকায় না আসায় এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কৃষকদের কাছ ধান সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে। চলতি মৌসুমে সদর উপজেলায় ১১৮৬ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিভাগ। সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে কৃষি কার্ডধারী কৃষক রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। পৌরসভায় ২ হাজার ৮৫১ জন, হলোখানায় ৩ হাজার ৭২১ জন, কাঁঠালবাড়ীতে ২ হাজার ৭৪৬ জন, বেলগাছায় ২ হাজার ২৪৯ জন, মোগলবাসায় ৪ হাজার ৬৪৯ জন, যাত্রাপুরে ২ হাজার ৪৭৮ জন, পাঁগাছীতে ২ হাজার ৭৬৬ জন, ঘোগাদহে ৪ হাজার ৬৭৩ জন, ভোগডাঙ্গায় ৬ হাজার ৯৯ জন কৃষককে রোপা-আমন ধান উৎপাদনকারী হিসেবে তিন ক্যাটাগরিতে মোট ৩২ হাজার ২৩২ জন কৃষকের তালিকা তৈরি করে উপজেলা কৃষি বিভাগ।

সরেজমিনে দেখা যায়, ইউনিয়নের সন্ন্যাসী গ্রামের কৃষিকার্ডে ১২৪২ নম্বর ধান উৎপাদনকারী নির্বাচিত ১২৮ তালিকায় ফজর বলেন, আমার শুধু ভিটে বাড়ি রয়েছে ১২ শতাংশ। আমার কৃষিকার্ড রয়েছে। সেই কার্ড খাদ্যগুদামে চাকরি করে শাহাজাদা নিয়েছে ৫শ টাকায়। গত টিপেও আমার নাম তালিকায় ছিল। সেবারও ৫শ টাকা দিয়ে কার্ড নেয় শাহাজাদা। ১৫ মণ ধান দিয়েছি এতে করে শাহাজাদা আমায় ১৬শ টাকা দিয়েছে। এবার কত মণ ধান দেব আর কত টাকা দেবে সেটা আলাপ হয়নি। একই এলাকার কৃষিকার্ড নম্বর ১৪৩৪ ও তালিকায় ১৪৬ নম্বরের নুর আলমের স্ত্রী শাহিদা বেগম বলেন, তালিকায় আমারও নাম উঠেছে। কৃষি কার্ডটা শুনছি ৫শ টাকায় শাহাজাদার কাছে দিয়েছে আমার স্বামী। গতবারও পেয়েছিল।

এবার ধান আবাদ না করলেও তালিকায় কীভাবে নাম এলো প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার স্বামীর সঙ্গে শাহাজাদার কী আলাপ হয়েছে জানি না। জমিজমা সম্পর্কে বলেন, আমাদের ১১ শতাংশ ভিটে-বাড়ি রয়েছে। সেটাও ভাগাভাগি হয়েছে।

কৃষিকার্ড নম্বর ১৩৮০ তালিকায় ১৩৬ নম্বরধারী আনছার আলীরও আবাদী জমি নেই বলে জানা যায়। এছাড়া মদাজালফারা গ্রামের কৃষিকার্ড নম্বর ১৩৩৯ তালিকায় ৩১০ নম্বরধারী আশরাফুল হক পেশায় একজন অটোরিকশা চালক।

আশরাফুলের স্ত্রী বলেন, তালিকায় নাম আছে। সেই কার্ড লিব্লু ৫শ টাকায় দিয়ে নিয়ে গেছে। ধান কেনা শেষ হলে আরও টাকা দেবে। ভিটে-বাড়ি ছাড়া নিজস্ব কোনো আবাদী জমি নেই। তবে তারা বর্গা নিয়ে জমি চাষ করলেও এবার তারা ধান আবাদ করেননি বলে জানান তিনি।

ওই ইউনিয়নের কৃষক হজুর আলী ও আব্দুল কুদ্দুছসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, সরকারিভাবে ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হলেও আমরা তা জানতে পারিনি। এলাকায় কোনো ধরনের প্রচারণা না করেই লটারির নামে আসল কৃষকদের বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান ও খাদ্য কর্মকর্তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কৌশলে তাদের পছন্দের লোকজনের নাম তালিকায় দিয়েছে।

স্থানীয় কৃষক জোবেদ আলী, ছাত্তার ও বাদশা জানান, সাধারণ কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান দিতে পারে না। ধান নিয়ে গেলে ১৫/২০ দিন পর্যন্ত গুদামের বাইরে রাখতে হয়। ধানে চিটাসহ অনেক কিছুর ভুল ধরে অফিসাররা। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই ৫শ/১ হাজার টাকা ঘুষ দিলে সব কিছুই ঠিক হয়ে যায়। না দিলে ফেরত আসতে হয়। খাদ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হয়রানির কারণে বাধ্য হয়ে অনেকেই দালালের কাছে কৃষিকার্ড বিক্রি করেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শাহাজাদা চৌধুরী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তালিকায় কীভাবে আমার ও আমার চাচার নাম এসেছে আমি জানি না। তালিকা প্রকাশের পর জানতে পারি।

টাকা দিয়ে কৃষিকার্ড কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে কেনা হয় না। গ্রামের মানুষজন উপকারের জন্য আসে তাই উপকার করি।

অপর অভিযুক্ত ব্যক্তি আব্দুর গফুর লিব্লু বলেন, আমার কেউ কোনো কার্ড দেয়নি। আমি এগুলোর ব্যবসা করি না, কারও কার্ড নিইনি। তালিকায় নিজের নাম ওঠার বিষয়ে কৌশলে বলেন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেই হয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী ইউপি সদস্য খাইরুল ইসলাম জানান,পরিষদের একমাত্র আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলর হওয়ায় চেয়ারম্যানের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকায় তালিকা থেকে আমাকে বাদ দিয়েছে। ফুড অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউপি চেয়ারম্যানের যোগসাজশে প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোকজনকে তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। এমন দুর্নীতি দেখে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুরহা পাননি বলে জানান।

এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান উমর ফারুক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো কৃষি কর্মকর্তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেন, কীভাবে কী হয়েছে আমি বলতে পারি না। কৃষি অফিসাররা যখন তালিকা করেছেন তখন পরিষদে কারও সঙ্গে পরামর্শ করেনি। এই বিষয়ে সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন দায় চাপান খাদ্য বিভাগের ওপর। শুধুমাত্র তালিকা দিয়েই কৃষি বিভাগের কাজ শেষ বলে জানান। এছাড়াও তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নীতিমালার কারণে এমন অনিয়ম হয়েছে বলেন তিনি।

হলোখানা ইউনিয়নের নির্বাচিত কৃষক তালিকা নিয়ে লিখিত অভিযোগের কথা স্বীকার করে দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট দেবেন বলে জানান, সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম মিয়া।

ওডি/ এফইউ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড