সোহেল রানা, সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে টেস্ট রিলিফ (টিআর) কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা হরিলুট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো প্রকল্পে বরাদ্দের অর্থের পুরোটাই আবার কোনো প্রকল্পে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ কাজ করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা.আব্দুল আজিজ ও তার ভাই আবু সাঈদ, ভাগ্নে আব্দুস সবুর ওরফে মিল্টন, তাড়াশ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নুর মামুনসহ কয়েক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা নানা কৌশলে এ প্রকল্পের টাকা লুটপাট করেছে। তবে কাজ না হলেও কাগজে-কলমে শতভাগ কাজ দেখানো হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সুত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দ্বিতীয় কিস্তিতে তাড়াশ উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজের অনুকুলে টিআরের ৪৩টি প্রকল্প ও কাবিখার ৯টি প্রকল্প, সাধারণ বরাদ্দে টিআরের ২৩ এবং কাবিখার ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাগজে কলমে প্রতিটি প্রকল্পে শতভাগ কাজ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে ইতোমধ্যে রিপোর্টও প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু সরেজমিনে পুরোই উল্টো চিত্র দেখা যায়। উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরগাতী দেলবারের বাড়ি থেকে কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু গত দেড় বছরে ওই রাস্তায় এক টুপড়ি মাটিও ফেলানো হয়নি।
এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন, তাইবুর রহমান ও সবুর জানান, রাস্তাটি দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুনেছি মেরামতের জন্য এমপি টিআর বরাদ্দ দিয়েছে কিন্তু কোনো কাজ করা হয়নি। পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
একই ইউনিয়নের সেরাজপুর রহমানের বাড়ি থেকে আজগর আলী বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য এমপি কোটায় টিআরের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে কোনো কাজ করা হয়নি। ওই গ্রামের আজগর আলী জানান, আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে টাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছি। এখানে টিআরের কোনো কাজ হয়নি।
তবে প্রায় ৭ মাস আগে স্থানীয় ইউপি সদস্য লেবু দুই ট্রাক মাটি ফেলে দিয়েছিল। বারুহাস ইউনিয়নের কাজিপুর পূর্বপাড়া সাহেব আলীর বাড়ি থেকে লয়মুদ্দীনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য টিআরের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল জানান, রাস্তাটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০ দিনের কর্মসূচির টাকা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে কাজের সেক্রেটারি শরিফুল ইসলাম জানান, এমপির ভাগ্নে মিল্টন প্রথমে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে কিছু কাজ করেছি। এখনো ১০ হাজার টাকা বাকি আছে। পরে এমপির ভাগ্নে মিল্টন ৫ হাজার টাকা দেয়। আর কোনো টাকা দেয়নি।
প্রকল্পের সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক জানান, আমি প্রকল্পের সম্পর্কে কিছু জানি না। কোথাও সই দেইনি। কত টাকা বরাদ্দ তাও জানি না। শুনেছি এমপির ছোট ভাই আবু সাঈদ ও মিল্টন টাকা দিয়েছে এলাকার যুবলীগ নেতা রফিকুল কাজ করেছে। তবে কত টাকা দিয়েছে তাও আমার জানা নেই।
একই ইউনিয়নের তাড়াশ-রানীর হাট রাস্তা সংলগ্ন আতাউরের বাড়ি থেকে গাজী সাইদুর রহমানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এক কোদাল মাটিও সেখানে ফেলা হয়নি।
আতাউর রহমান জানান, বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়ে রাস্তাটি মেরামত করতে পারিনি। পরে নিজেই এলাকাবাসীর সহায়তায় রাস্তাটি মেরামত করেছি। যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে তবে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিনসাড়া-কুসুম্বি পাকা রাস্তায় লালমিয়ার বাড়ি থেকে ঝিনাই গাড়ির পাড় পর্যন্ত রাস্তা মেরামতে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো কাজ করা হয়নি।
বিনসাড়া গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকলীগের ওয়ার্ড সভাপতি শহীদুল ইসলাম জানান, বিগত ৫ বছরের মধ্যেও এ রাস্তায় কোনো মাটি বা মেরামত হয়নি। কুসুম্বি আয়সা নাজাতুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ উন্নয়নে ৫০ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া থাকলেও বাস্তবে কোনো প্রকার কাজ হয়নি।
কুসুম্বি আয়সা নাজাতুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের কর্তৃপক্ষ জানায়, কাজ তো দূরের কথা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ আছে কি-না এ বিষয়টি আমরা জানি না।
পালাশী মাদ্রাসা ভরাটে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ করা হয়নি। শুধু এমপির অনুকূলে বরাদ্দের প্রকল্পগুলো নয়, উপজেলার প্রতিটি প্রকল্পের অবস্থা একই রকম।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, টিআরের সব টাকা সংসদ সদস্যের সহায়তা তার ভাই আবু সাঈদ ও ভাগ্নে মিল্টন সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সহায়তা আত্মসাৎ করেছে। প্রথমবারের মতো ডা. আব্দুল আজিজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে টিআর-কাবিখার অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় তৃনমূল নেতাকর্মীদের নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অবিলম্বে এ সকল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা নূর মামুন বলেন, প্রাথমিকভাবে সুষ্ঠুভাবে কাজ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়ায় বিল প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে তাই পুনরায় প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করার পর প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। এর বেশি কিছু এখন বলা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্যের ভাই আবু সাইদ জানান, প্রকল্পের কাজ হবে কি হবে না, সেটা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস বুঝবে? এতে আপনাদের সমস্যা কি? আপনাদের কোনো সমস্যা হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
এ বিষয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফ্ফাত জাহান মুঠোফোনে জানান, প্রকল্পের তদারকি করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নূর মামুন। প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে আমার বাসায় এসে স্বাক্ষর নিয়ে বিল প্রদান করেছেন।
তবে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, অভিযোগ থাকলে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ জানান, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। তবে কোনো অনিয়ম দুর্নীতি হলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ওডি/এসএএফ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড