• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

চলনবিল জুড়ে চলছে ঐতিহ্যবাহী ‘পলো উৎসব’

  আমিনুল ইসলাম জুয়েল, পাবনা

০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:৩৮
সৌখিন মৎস্য শিকারীদের পদচারণায় মুখর চলনবিল
সৌখিন মৎস্য শিকারীদের পদচারণায় মুখর চলনবিল (ছবি : দৈনিক অধিকার)

চলনবিলসহ পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরের বিভিন্ন বিলে এখন চলছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো বাওয়া উৎসব।’ গত কয়েকদিন ধরেই সৌখিন মৎস্য শিকারীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে বিলপাড়।

এক সময়ের মিঠা পানির মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত চলনবিলে এখন মাছের আকাল থাকলেও বাউতদের (সৌখিন মৎস্য শিকারী) আনন্দের কমতি নেই। ‘চলো পলো নামি’ বলে দলে- দলে বাউত নামছে বিভিন্ন বিলে-খালে। তাদের পলোতে কম-বেশি বাহারি জাতের সব মাছ ধরা পড়ছে।

চলনবিল এলাকার বিলকুড়ালিয়া, খলিশাগাড়ি, বড়বিলা, জিয়লগাড়ি, সানকিভাঙ্গা বিল, গুমানী, চিকনাই নদীতে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে শত শত বাউত প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামছেন। এ যেন হারিয়ে যাওয়া উৎসব নতুন করে ফিরে পাওয়া।

এলাকায় রীতিমতো মাইকিং করে খাল-বিলের পাড়ে ভোর না হতেই বিভিন্ন রকম ‘ধ্বনি’ দিয়ে পলো হাতে বাউতদের নামতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও বা গলা পানিতে মাছ ধরছেন সৌখিন মৎস শিকারীরা। কিছু সৌখিন মানুষ চলনবিল পাড়ে নিকটাত্মীয়ের বাড়ি থাকছেন। সব মিলিয়ে এখন বিলপাড়ে এক ধরনের উৎসব আমেজ চলছে।

শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ভাঙ্গুড়া উপজেলার মন্ডুতোষ ইউনিয়নের রুহুল বিলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় অনেকটাই পানিশূন্য বিল বুক চিতিয়ে দিয়েছে। মূল বিল, খালে কিছু পানি অবশিষ্ট রয়েছে। এ সময়ই এলাকার সৌখিন মানুষেরা যোগ দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো বাওয়া উৎসবে।’

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এরপর দল বেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা। এ উৎসবে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসছেন।

এদের হাতে পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম চোখে পড়ে। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসঙ্গে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাছ পাওয়া না পাওয়া তাদের কাছে বড় কথা নয়, ব্যতিক্রমী এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগই যেন তাদের কাছে মুখ্য। তবে অনেকেই বোয়াল, রুই-কাতলা, শোল মাছ শিকার করে বাড়ি ফিরেছেন আনন্দের সঙ্গে।

এ উৎসবে যোগ দিতে আসা ঈশ্বরদীর ৫৫ বছর বয়সী ময়েজ উদ্দীন জানান, পলো দিয়ে মাছ ধরা তার দীর্ঘদিনের শখ। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছরে চলন বিলের রুহুল বিলে চলে এসেছেন। তবে আগেকার তুলনায় দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নাটোর জেলা থেকে আগত মৎস্য শিকারী আবু বক্কার বলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাউতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই প্রতি বছর তিনি মাছ শিকার করতে আসি। মাছ পাই আর না পাই এটি বড় কথা না, বড় হলো শখ মেটানো।

বড়াইগ্রামের আফসার আলী মাছ না পেয়ে হতাশার সুরে বলেন, এখানকার লোকজন আগের রাতে জাল দিয়ে মাছ মেরে নিয়েছে। তাই এখন আর তেমন মাছ নেই এই বিলে।

পাবনা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মোজাহার আলী, চাটমোহরের দাঁথিয়া গ্রামের এনামুল হক, বোয়ালমারী গ্রামের আনিসুর রহমান ও বেলাল হোসেনসহ অন্যান্য বাউতরা জানান, হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ সবাই পায় না। একজন পেলে আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই। কে মাছ পেল আর কে পেল না তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই কারো। প্রতি বছর আনন্দের জন্য, মাছ ধরার জন্য এই সময়টার অপেক্ষায় থাকেন বলে জানান তারা।

ছাইকোলা ডিগ্রি কলেজের জীববিদ্যার সহকারী অধ্যাপক কাজী মান্নাফ জানান, চলন বিলের মাছ ধরার এই পলো বাওয়া উৎসব, ছোটবেলায় আমি অনেক দেখেছি। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পানিশূন্য বিলে মাছ নেই বললেই চলে। আর প্রায় সব বিলই তো এখন প্রভাবশালী অমৎস্যজীবীদের দখলে। সেখানে পলো ফেলা মুশকিল।’

এ ব্যাপারে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুর রউফ জানান, বাউত বা পলো উৎসব গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনো টিকে আছে। বড় বিল, ডেঙ্গার বিল, খলিশাগাড়ি বিল, রহুল বিল, ডিকশী বিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ ধরছে। তবে বাউত উৎসবের ফলে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ, শ্যাওলা জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস খাদ্য, পানির উপকারী অণুজীব নষ্ট হয়ে যায়। এতে জীববৈচিত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ওডি/ এফইউ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড