• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মুসলিম স্থাপত্যের গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী শাহী মসজিদ

  নজরুল ইসলাম শুভ, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ

১৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:২০
সুলতানি আমলের মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন
সুলতানি আমলে নির্মিত গোয়ালদী শাহী মসজিদ (ছবি : দৈনিক অধিকার)

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের অন্যতম রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। এই সোনারগাঁয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বার ভূইয়া ও সুলতানি আমলের নানা স্থাপনা ও মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন। প্রাচীন পানাম নগরীর অদূরে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে গোয়ালদীতে সুলতানি আমলে নির্মিত শাহী মসজিদটি অবস্থিত।

এছাড়া গোয়ালদীর অসাধারণ প্রাচীন মসজিদটির পশ্চিমপাশে একটি পুরনো পুকুর ছিল। বর্তমানে সেটি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য বিলীন করে এখানে অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোর মাঝখানে দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি শোভা পাচ্ছে।

আশির দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই শাহী মসজিদটিকে প্রত্নতত্ত্বের আওতাভুক্ত করে এটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সে সময় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত বিভাগ মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার করে এবং এতে ফুল, লতাপাতা নকশা সংবলিত পোড়ামাটির ফলক স্থাপন করে মসজিদটির প্রকৃত রূপ অনেকটাই বদলে যায়। কারণ এর গায়ে যেসব মূল্যবান কারুকাজ-খচিত পাথরের ফলক ছিল, সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্তির আগেই চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।

সোনারগাঁয়ে শাহী মসজিদের ইতিহাস সংবলিত একটি সাইনবোর্ড প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর টাঙিয়ে রেখেছে। তাতে লেখা আছে, মোগল আমলে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের আগে সোনারগাঁয়ে বার ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ, মুসা খাঁ ও এর আগে সুলতানদের রাজধানী ছিল। রাজধানী ও রাজসভার জন্য মনোরম ইমারত ছাড়াও মুসলিম শাসকেরা এখানে মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ করেন। তার এক অন্যতম নিদর্শন সোনারগাঁয়ের শাহী মসজিদ।

এদিকে যথাযিথ সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে সোনারগাঁয়ের মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন গোয়ালদী শাহী মসজিদের একটি পিলার ও ভেতরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে। খসে পড়ছে ফুল, লতাপাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা ও আরবি লিপির অলঙ্করণ। সুলতানি আমলের এ মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়রা দাবি জানিয়েছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সরকার ১৯৭৫ সাল থেকে এ মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য সার্বিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ইতিহাস বিকৃত না হওয়ার জন্য প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তর মসজিদের ইতিহাস সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে। তবে পাঁচশ বছরের পুরনো মসজিদটি চূড়ান্তভাবে সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত¡ অধিদপ্তরে আবেদন করা হলেও সর্বশেষ কী অবস্থায় রয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় পানাম সিটির এলাকার ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গির আলম ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেছি। এ অর্থবছরে কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। আশা করছি, খুব দ্রুতই সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।

প্রত্নতত্ত¡ববিদদের অনুমান, আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ বাংলার মসনদে আহরণের পর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের একান্ত অনুগত মোল্লা হিজবর আকবর খাঁ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার আগে সোনারগাঁ পৌরসভার ছায়া সুনিবিড় গোয়ালদী গ্রামে এ শাহী মসজিদটির অবস্থান।

কথিত আছে, সুদীর্ঘ বছর ঘন বনজঙ্গলে আবৃত ছিল এ মসজিদটি। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদটি আবিষ্কার করলে একে স্থানীয়ভাবে গায়েবি মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়। এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির এ মসজিদটির প্রতিটি দেয়াল প্রায় তিন মিটার চওড়া এবং এর চার কোনায় চারটি খিলান তৈরি করা হয়েছে। দ্বিকেন্দ্রিক রীতিতে মসজিদটির নির্মাণ শৈলীতে তৎকালীন সুলতানি আমলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কালো রঙের কষ্টিপাথরে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে এর মেহরাব। মেহরাবের গায়ে ফুল লতা-পাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা এবং আরবি লিপির অলঙ্করণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আগে অধ্যাপক দানী মসজিদটি দেখতে এসেছিলেন। তখন তিনি মসজিদটি টিলা আকারের মতো দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থকার আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লিখেছেন, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে মসজিদটিকে প্রথম যখন তিনি দেখেছেন, তখন সেখানে তেমন কোনো উঁচু ভূমি দেখেননি। এ প্রাচীন মসজিদটি ১৫ শাবান ৯২৫ হিজরিতে নির্মিত।

সোনারগাঁ ইতিহাস গ্রন্থের ১৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে- ১২ আগস্ট ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসাইন শাহের শাসনামলে মোল্লা হিজবর আকবর খান গোয়ালদী মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ ও তার অনুসারীরা একান্তভাবে ধর্মীয় ইবাদতের জন্যই গভীর জঙ্গলে মসজিদটি স্থাপন করেন। মসজিদটিতে একসঙ্গে ১৫-২০ জন মুসলমান নামাজ আদায় করতে পারতেন। এখন আর কেউ ওই মসজিদে নামাজ পড়েন না। পর্যটকদের জন্য এ মসজিদটি সংরক্ষণ করেছে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর। সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী শাহী মসজিদটি বর্তমানে পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থাপনা।

সোনারগাঁ সাহিত্য নিকেতনের সভাপতি বাবুল মোশারফ বলেন, সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন পুরাকীর্তি পরিদর্শনে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান গোয়ালদী মসজিদ। সুলতানি আমলের গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম সাক্ষী এ মসজিদ।

পঞ্চদশ শতকের মসলিনখ্যাত বাংলার প্রাচীন রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। সোনারগাঁয়ের অসংখ্য পুরাকীর্তির মধ্যে গোয়ালদীর শৈল্পিক মসজিদটি অন্যতম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সেন ও পালবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটলে মুসলিম সুলতানরা রাজ্য শাসন করেছেন। যখনই মুসলিম শাসকরা কোনো প্রদেশ বা অঞ্চল জয় করেছেন, তখন সেখানে শৈল্পিক মসজিদ নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশে সুলতানি আমলের বেশকিছু শাহী মসজিদ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এসব ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলোর মধ্যে গোয়ালদী মসজিদ অন্যতম।

ওডি/ এফইউ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড