• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও নেই ২২ হাজার পরিবারের

  মো. মুশফিকুর রহমান, সাতক্ষীরা

১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:১৭
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক বৃদ্ধা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কবলে পড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল। ৭ ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে বুলবুল সাতক্ষীরা জেলার সর্বত্র তার চিহ্ন রেখে গেছে। কিন্তু এ ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়।

শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের প্রায় ৭৭ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ২২ হাজার ঘরবাড়ি। এর মধ্যে আট হাজার ৮শ ঘরবাড়ি একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ হাজার ২শ ঘরবাড়ি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের এই তাণ্ডবলীলার চার দিন পেরিয়ে গেলেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো রকম সহযোগিতা এখনো পাননি ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষ।

সরজমিনে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ, ইশ্বরীপুর, বুড়িগোয়ালীনি, গাবুরাসহ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাহাকার। মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও উড়িয়ে নিয়ে গেছে বুলবুল, নষ্ট হয়েছে মাছ ও কাঁকড়ার ঘের। বুলবুলের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। এখনো অনেক এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। রাস্তার দুই ধারের গাছ ও বিদ্যুৎ এর খুঁটি ভেঙে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই আশ্রয় কেন্দ্রে না পৌঁছালে এখানে অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারত। আর যখন বুলবুল এখানে আঘাত হানে তখন সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে ‘ভাটা’ চলায় কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে। সে সময় যদি ভাটা না হয়ে জোয়ার থাকতো তাহলে স্বাভাবিক এর চেয়ে নদীর পানির উচ্চতা আরও ৬ থেকে ৭ ফুট বেড়ে যেত। তলিয়ে যেত পুরো শ্যামনগর উপজেলা। তখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যেত।

নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে শ্যামনগর এলাকাবাসী। আইলা, সিডর, ফণি ও সর্বশেষ বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া তারা। কিন্তু বুলবুল আঘাত হানার চার দিন পেরিয়ে গেলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি শ্যামনগর উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ।

তবে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে তিনি বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকার ১শ জনের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।

শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বাসিন্দা নূর নেসা বেগম ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমার তিনটি ঘর একেবারেই উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরের কোনো কিছু রক্ষা পায়নি। আরেকটি ঘরের চাল উড়ে গেছে। ঝড়ের পর থেকে নাওয়া খাওয়া বন্ধ। খাবো কী করে রান্না করার জায়গায় তো নেই।

তিনি আরও বলেন, ঝড়ের দিন রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে এক বেলা খাবার পেয়েছিলাম এরপর আর কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করছি। তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য তাকে আইডি কার্ডের ফটোকপি এবং ছবি জমা দিতে বলেছেন যদি কখনো কোনো ত্রাণ আসে তাকে দিবেন বলে।

একই এলাকার বিধবা মোমেনা বেগম বলেন, ঝড়ে আমার ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি বিধবা মানুষ তার ওপর আমার ঘরে আমার গর্ভবতী মেয়ে। চরম বিপাকে পড়েছি কীভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

ওই এলাকার কাঁকড়া খামারি রমজান আলী বলেন, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কাঁকড়ার প্রজেক্ট শুরু করি। কোনো রকম লাভের মুখ দেখার আগেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমার সব শেষ করে দিয়েছে। ঘেরে মিষ্টি পানি প্রবেশ করায় কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। কী করে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেব বুঝতে পারছি না।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের জবেদা বেগম বলেন, আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার একটি দোকানের ওপর ভর করে চলত। কিন্তু বুলবুল আমাদের দোকানটা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। দোকান হারিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মাছের ঘের ও ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সাতক্ষীরা জেলার ৪৭ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ব্যাপারে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, আমি ঘূর্ণিঝড় কবলিত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও বুড়িগোয়ালীনী ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছি, এসব এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ের সময় নদীতে ভাটা ছিল এজন্য ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। অন্যথায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হত। তবে সবচেয়ে ভালো কথা আমাদের জানের ক্ষতি কম হয়েছে। যা হয়েছে মালের ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে জানানো হয়েছে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা কখনো মাথায় রাখা যাবে না। সরকারের সম্পদ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী আমি জেলা প্রশাসককে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির জন্য বলেছি।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (৮ নভেম্বর) দিবাগত রাত ২টার দিকে সাতক্ষীরায় আঘাত হানা শুরু করে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। প্রায় ৭ ঘণ্টা পর শনিবার (৯ নভেম্বর) সকাল ৯টার দিকে কমতে শুরু করে ঝড়ের প্রভাব। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে সাতক্ষীরায় ৪৭ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০ হাজার ঘরবাড়ি।

এছাড়াও পাঁচ হাজার ১৭টি মৎস্য ঘের এবং ১৫ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন সম্পূর্ণ ও ১০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ধান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই হাজার হেক্টর জমির সবজি, পান, সরিষা ও কুলসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

ওডি/এএসএল

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড