• বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জনশক্তি রপ্তানির বিকল্প শ্রমবাজার

  মোহাম্মদ রাজিব হাসান

০৬ নভেম্বর ২০২০, ১১:৪৯
প্রফেসর
প্রফেসর মোহাম্মদ রাজিব হাসান (ছবি : দৈনিক অধিকার)

বৈশ্বিক করোনা মহামারিকালীন সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এই প্রভাব বিশেষত পরিলক্ষিত হচ্ছে অদক্ষ এবং স্বল্প-দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে। পত্রিকার পাতা কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুললেই আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরছেন।

২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যমতে, দৈনিক প্রায় ২ হাজার শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন। উপরন্তু, প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক নিঃস্ব, ছুটিতে এসে আটকা পড়েছেন ২ লাখ, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ফেরত এসেছেন ১ লাখ, ভিসা করেও যেতে পারেননি ১ লাখ এবং নতুন ৩ লাখ শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারেননি।

আরও গুরুতর খবর, মালয়েশিয়া (যেটি বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার) তারাও বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে (দৈনিক প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

যদিও বিগত কয়েক মাস আমাদের প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েনি বরং রেকর্ড গড়েছে তথাপি উপরোক্ত পরিসংখ্যান শুধু উদ্বেগের নয় ভয়েরও কারণ বটে। প্রবাসী আয়ে রেকর্ডের কারণ হতে পারে করোনা এবং কুরবানির ইদকে সামনে রেখে স্থায়ী অভিবাসীগণ বেশি করে রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। উপরন্তু, অপ্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমের পরিবর্তে সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের সরবরাহ বেড়েছে, তাই মনে হচ্ছে প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েনি। কিন্তু নিয়মিত যে প্রবাসী আয় অর্থাৎ অস্থায়ী শ্রমিকদের মাধ্যমে যে আয় তাতে নিশ্চিত ভাটা পড়েছে।

যে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন তাদের বেশিরভাগই নিঃস্ব। এ ক্ষেত্রে তাদের নতুন করে দেশেই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা সহজ হবে না। কারণ তাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং বয়সের পাশাপাশি দেশে কাজের ধরনও ভিন্ন। তাই শুধুমাত্র যারা ফেরত আসছেন তাদের জন্য নয় বরং যারা নিজেদের শ্রমকে বিদেশে রপ্তানি করতে চান তাদের জন্য এখনই নতুন শ্রমবাজার সন্ধান করতে হবে। আর নতুন এবং বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে নতুন গন্তব্য।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বৎসর এইচ-২এ (H-2A) এবং এইচ-২বি (H-2B) ভিসার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক আমদানি করে থাকে। এইচ-২এ ভিসাধারী শ্রমিকদেরকে মূলত কৃষি শ্রমিক এবং এইচ-২বি ভিসাধারী শ্রমিকদেরকে অ-কৃষিশ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ধরনের শ্রমিকরা সাধারণত সাময়িক, অস্থায়ী বা মৌসুমি শ্রমিক নামে পরিচিত। তারা একবার ভিসার মাধ্যমে এক বৎসর থেকে সর্বোচ্চ তিন বৎসর একাধারে আমেরিকায় অবস্থান করে কাজ করতে পারেন। তবে ৩ বৎসর পরে একজন শ্রমিককে অবশ্যই দেশে ফেরত আসতে হবে এবং নিয়োগকর্তা চাইলে তিনি ৩ মাস পরেই আবার আমেরিকায় ফেরত যেতে পারবেন।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিপুল পরিমাণ ধান, গম, ভুট্টা, তূলা, আখসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি উৎপাদিত হয়। এসমস্ত ফসল উৎপাদনের জন্য প্রচুর সংখ্যক কৃষি শ্রমিকের প্রয়োজন। অধিকন্তু প্রতি বৎসর প্রচুর পরিমাণ মাছ, চাষের মাধ্যমে উৎপাদন ছাড়াও সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। যে কারণে প্রতি বৎসর ২-১০ লাখ কৃষি শ্রমিক বিশ্বের প্রায় ১ শত ৮০টি দেশ থেকে আমদানি করা হয়।

অপরদিকে, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ, রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি বিনির্মাণ, হোটেল-রেস্তোরায় কাজ, গাছ লাগানো-মালি, ক্লিনার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে প্রতি বৎসর ৬৬ হাজার শ্রমিক আমদানি করে থাকে। এই সমস্ত শ্রমিকদেরকে অ-কৃষি শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কৃষি শ্রমিক আমদানির কোন ঊর্ধ্বসীমা না থাকলেও বৎসরে মাত্র ৬৬ হাজার অকৃষি শ্রমিক আমদানি করা যায়। সেটিও আবার দুই ভাগে বিভক্ত, অক্টোবর থেকে মার্চের মধ্যে ৩৩ হাজার আর বাকী ৩৩ হাজার এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

কৃষি এবং অকৃষি উভয় শ্রমিকরাই অনেক সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের যাতায়াত এবং থাকার ব্যবস্থা নিয়োগকর্তাকে করতে হয়। উপরন্তু, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০১১ সালে এক নির্বাহী আদেশ বলে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ৮ দশমিক ৭ ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ১৪ দশমিক ৭৭ ডলারে নির্ধারণ করেন। অধিকন্তু, মৌসুমে বাড়তি (ওভারটাইম) কাজের সুবিধাতো রয়েছেই।

এই ধরণের শ্রমিকদের সাথে নিয়োগকর্তার যেহেতু একটি সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় তাই শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা এবং কাজের প্রতি সততা ও নিষ্ঠা থাকলে একই শ্রমিক যুগ যুগ ধরে একই মালিকের অধীনে কাজ করতে পারেন। একবার ভিসা প্রাপ্তির পর একজন শ্রমিক যেহেতু একটানা ৩ বৎসর পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করতে পারেন সেক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়োগকর্তারা শ্রমিকদের পরিবারকেও কাছে আনার জন্য স্পন্সরশীপ প্রদান করে থাকেন। পরিবার কাছে থাকলে শ্রমিকদের যেমন কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় তেমনি পরিবারের সদস্যরাও উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করে।

কৃষি এবং অ-কৃষি উভয় ধরণের শ্রমিক আমদানির জন্য প্রক্রিয়াটি একটু ভিন্ন। উভয় শ্রমিকের জন্য আমেরিকার একজন নিয়োগকর্তা ডিপার্টমেন্ট অব লেবারে আবেদন করে থাকেন। তবে নিয়োগকর্তাকে এটাও প্রমাণ করতে হয় যে, সেখানে কৃষি বা অকৃষি কাজের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আমেরিকান শ্রমিকের স্বল্পতা রয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব লেবার যখন নিশ্চিত হয় যে প্রকৃতই শ্রমিকের স্বল্পতা রয়েছে এবং নিয়োগকর্তার অস্থায়ী শ্রমিক প্রয়োজন, তখন ডিপার্টমেন্ট অব লেবার নিয়োগকর্তাকে শ্রমিকের নাম, পরিচয় ও দেশ উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় আই-১২৯ ফর্ম জমাদানের অনুমতি প্রদান করে থাকে।

অপরদিকে, আবেদনে উল্লিখিত শ্রমিক নিজের দেশের আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে ভিসার আবেদন করে থাকেন। ভিসা প্রাপ্তির পর একজন শ্রমিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গমনের পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন।

আরও পড়ুন : প্রকৃতি এমন আচরণ করছে কেন?

এমপ্লয়মেন্ট ও ট্রেইনিং এডমিনিস্ট্রেশন (ইটিএ) এর মাধ্যমে বর্তমানে চারটি ন্যাশনাল প্রসেসিং সেন্টার যথা আটলান্টা, জর্জিয়া, শিকাগো এবং ইলিনয় থেকে কৃষি ও অকৃষি উভয় শ্রমিকের জন্য ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সুবিধা রয়েছে। এর সাথে জড়িত অন্যান্য সংস্থাগুলো হলো ডিপার্টমেন্ট অব লেবার (ডি ও এল), ইউনাইটেড স্টেটস সিটিজেনশিপ ও ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউ এস সি আই এস), এবং ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস)। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর (সেক্রেটারি অব স্টেট) অনুমোদনক্রমে স্বরাষ্ট্র সচিব শ্রমিক আমদানিযোগ্য দেশ সমূহের তালিকা প্রকাশ করে থাকেন। এই তালিকা এক বৎসর মেয়াদী হয় এবং পরিবর্তিত হতে পারে।

শ্রমশক্তি রপ্তানির এই সুবিধা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি রপ্তানিকারকদের একসাথে কাজ করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোকে বিদেশ থেকে ফেরত আসাসহ বিদেশ গমনেচ্ছুদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করতে হবে। তালিকায় শ্রমিকের পেশা, দক্ষতাসহ স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা, নাম, বয়স, লিঙ্গ, অভিজ্ঞতা, সম্ভব হলে পাসপোর্ট নাম্বার, ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করতে হবে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক সফলতার ওপর নির্ভর করবে আমাদের দেশের নাম কৃষি ও অকৃষি শ্রমিক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে লিপিবদ্ধ করার। এটি অসম্ভব কিছু নয়।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমুদ্র বিজয় থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর তৈরিকৃত তালিকা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং আমাদের শ্রমিকরা কেন যোগ্য তা তাদের বুঝাতে হবে। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিয়োগকর্তা ও নিয়োগ প্রার্থীদের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির মূল ভূমিকাটি গ্রহণ করতে হবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরই। নিয়োগকর্তাদের কাছে নিজ দেশের শ্রমিকের কর্মদক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ইত্যাদি তুলে ধরতে হবে। এর জন্য তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে নিয়োগকর্তাদের নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি এবং এগুলো আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের ওয়েবসাইটে সহজলভ্য।

যেহেতু আমদের দেশের শ্রমিকদের তালিকাভুক্ত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ সেহেতু জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এবং শ্রমশক্তি রপ্তানিকারকদের সম্মিলিতভাবে নিয়োগকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তার জন্য দরকার হলে সশরীরে ভ্রমণ করতে হবে এবং নিয়োগকর্তাদেরকে বুঝাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সরকারি প্রণোদনাও প্রদান করতে হবে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, লুইজিয়ানা, আলাবামা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, ইত্যাদি অঙ্গরাজ্যের আবহাওয়া অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। আর এসমস্ত অঙ্গরাজ্যেই কৃষি ও অকৃষি শ্রমিকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাই দেরি না করে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা স্বভাবতই পরিশ্রমী। একবার যদি আমাদের দেশের নাম তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয় তবে ভবিষ্যতে এর সুফল আমরা পেতেই থাকব। সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা ও অবৈধ পথে জনশক্তি রপ্তানির প্রবণতা কমবে এবং দেশের সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

চলমান আলোচিত ঘটনা বা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য সমসাময়িক বিষয়ে আপনার মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইলকরুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড