ড. রাশিদ আসকারী
বর্তমান সময়ের এক নম্বরের সমস্যা কি জানতে চাইলে মনে হয় পৃথিবীতে একজনও মিলবেনা যে করোনা সংক্রমণ ছাড়া অন্য কোনো উত্তর দেবে। হ্যাঁ গ্রহণযোগ্য উত্তর একটাই। করোনা ভাইরাস ডিজিস ২০১৯, যার অ্যাক্রোনিম হলো কোভিড-১৯। কো হলো করোনা, ভি হলো ভাইরাস এবং ড হলো ডিজিস। আর ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রথম সংক্রমণ সনাক্ত হয় বিধায় ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে বসেছে কোভিড -এর সাথে। চীনের উহান প্রদেশে যাত্রারম্ভ করে এরই মধ্যে বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে ফেলেছে এই ভাইরাস। তাণ্ডব চালিয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশে; চালাচ্ছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন করোনা মানে এক মূর্তিমান বিভীষিকা। এর হাত থেকে নিস্তার মিলছে না রাজা-প্রজা, বাদশা-ফকির-ধনী-দরিদ্র কারুরই। মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর দেশ এবং ভূখণ্ড মিলে ২০১টি জনপদ। মহামারি পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নয়। মধ্যযুগের শেষপাদে (১৩৪৬-১৩৫৩) বিউবোনিক প্লেগের দ্বারা সংক্রমিত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়াকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছিলো। সর্বনিম্ন ৭৫ মিলিয়ন এবং সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন মানুষ সেই ভয়াল ‘কৃষ্ণ মৃত্যুর’ শিকার হয়েছিলো বলে জানা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাদুর্ভূত হওয়া ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষকে সংক্রমিত করে ৫০ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নেয়। মরণব্যাধি এইডসও বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ১৯৮১ সালের পর থেকে ৩৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। এছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা কেন্দ্রিক মহামারি যেমন ১৮৮৯ সালের ‘রাশিয়ান ফ্লু’, ১৯৫৬ সালের ‘এশিয়ান ফ্লু’ কিংবা ১৯৬৮ সালের ‘হংকং ফ্লু’ও কম বিপদজ্জনক ছিলো না। অধিকন্তু, নিপা ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু, ডেঙ্গু কিংবা চিকনগুনিয়াকেও খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। কিন্তু সব কিছুকেই যেনো ছাড়িয়ে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস এবং তজ্জনিত বিরাজমান আতংক। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অন্তহীন অনিশ্চয়তার হাত থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন জার্মান অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার। ভয়াল করোনা কবলিত ইতালিকে রক্ষার সকল পার্থিব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আকাশের পানে হাত তুলে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন দেশটির অসহায় প্রধানমন্ত্রী জুসেপে কোনতে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা পৃথিবীর জন্য জরুরী অবস্থা জারি করেছে। লকডাউন হয়ে পড়েছে সমগ্র মানবজাতি।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জনমনে ভীতির প্রধান কারণ সম্ভবত এর অতি দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা। এবং এই সংক্রমণ হাঁচি-কাশির মধ্য দিয়ে তো বটেই, এমন কি কথা বলার মাধ্যমেও আক্রান্ত ব্যক্তির আপার রেসপিরেটরি ট্রাক্ট থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। আতঙ্কের দ্বিতীয় কারণ হলো- অদ্যাবধি কোভিড-১৯-এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয় নাই। বাজারে ঔষধের বন্দোবস্ত থাকলে রোগীর মনোবল এমনিতেই চাঙ্গা থাকে। কিন্তু করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব এতোটাই আকস্মিক যে, প্রতিরোধক এবং প্রতিশেধকবিহীন মানুষের ওপর এই প্রাণঘাতী আণুবীক্ষণিক শত্রু একতরফা দাপট খাটাচ্ছে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি শিশু এবং যুবাদের ওপর করোনার প্রকট ততোটা প্রবল নয় বলে যে আশ্বাসের বাণী ছড়ানো হয়েছিল, তাও সর্বৈব অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশসমূহের ক্ষেত্রে যে সুবিধের কথা বলা হয়েছিলো, তাও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে থোড়াই কেয়ার না করে গৃষ্মমন্ডলীয় দেশসমূহেকে একের পর এক ধরাশায়ী করে ফেলেছে করোনা ভাইরাস। বিশ্বের বড়ো বড়ো শহর একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ কিংবা কোলকাতা-ঢাকাকে ভর দুপুরে দেখলেও মৃতপুরি মনে হয়। এই কদিন আগে যে মানুষটি ঘড়ির উল্টোদিকে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো তার আজ সময় কাটেনা। দেহঘড়ি ইউটার্ন নিয়েছে। ফেসবুকের ডান সাইড বারে সবুজ ফুটকিগুলো সারারাত সক্রিয় থাকে। ফলে মধ্যাহ্নে শয্যাত্যাগ। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ যুক্ত হয়ে ব্রাঞ্চে পর্যবসিত হওয়া। মোটকথা, করোনাকাল মানবজীবনকে একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে। ভীতি-আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার জালে আবদ্ধ সময়ই করোনাকাল।
কোভিড নাইনটিন যেহেতু কেবল মহামারিই নয়, বৈশ্বিক মহামারি, তাই বাংলাদেশও এর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ৭ মার্চ ২০২০-এ দেশের রোগতত্ত্ব ইন্সটিটিউট ইতালি ফেরত তিনজনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সন্ধান পায়। মার্চের শেষ পর্যন্ত সংক্রমণের মাত্রা নিম্ন পর্যায়ে থাকলেও এপ্রিল পড়লেই তা ঊর্ধ্বগামী হয়। মধ্যে এপ্রিলের পর এই উল্লম্ফনের মাত্রা আরোও বাড়তে তাকে । তবে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের এই দেশে, যেখানে লক ডাউন কিংবা সোশাল ডিসট্যান্সিং পুরোমাত্রায় কার্যকর করা যাচ্ছেনা, কিংবা যেখানে লক্ষনাক্রান্তের তুলনায় টেস্টিং কিটসের পরিমাণ একেবারেই অল্প, সেখানে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ একটু কষ্টকরই বটে। আর ঠিক সেখানেই সমস্যাটি জটিলতর হচ্ছে। করোনা মোকাবেলার প্রথম অনিবার্য শর্ত হলো- আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতেই হবে। পরীক্ষা এড়ানো আক্রান্তেরা করোনাবাহক হিসেবে নির্বিঘ্নে করোনা সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটাবে। যে বিস্ফোরণকে পরিভাষাগত ভাবে বলা যায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। লক্ষনাক্রান্তদের যথাযথভাবে পরীক্ষা করে ফলাফলানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে পুরো করোনা বিরোধী অভিযান অর্থহীন হয়ে পড়বে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সম্ভাবনার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করে নিয়েছেন এবং ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সংক্রামক রোগ( প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর ১১(১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছেন। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত। তাই এ-ধরনের মহামারি সংক্রমণ লুকানো আত্মহননের সামিল। বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার পথে বেশ কিছু শক্তি বাঁধা রয়েছে। সেগুলো উপলব্ধি করে অপসারণের ব্যবস্থা না করলে ঈপ্সিত ফলাফল মিলবে না। বাঙালিরা অনেক বেশি সামাজিক, আড্ডাপ্রিয় এবং বহির্মুখী। চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলা একটি অতি প্রিয় বাঙালি স্বভাব। তাই করোনা সংক্রমণ পরিহারের জন্য সঙ্গ নিরোধ ব্যবস্থা , আত্ম-অন্তরণ কিংবা ঘৃত-অন্তরণ ব্যবস্থা খুব একটা কাজ করছে না। কিন্তু এটিকে কাজ করাতেই হবে। সামাজিক মেলামেশা করোনা সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম। এ ব্যাপারে চার্চ এবং ক্যাসিনো উভয়ই ঐক্যমত্য পোষণ করছে এবং বিশ্বব্যাপী তা গৃহীতও হয়েছে। আর পরস্পর-বিরোধী এই দুই প্রতিষ্ঠান কোন ব্যাপারে যখন একই মত পোষণ করে তখন বুঝতে হবে যে ব্যাপারটি সত্যিই গুরুতর। প্রার্থনালয়ে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, ক্যাসিনো বন্ধ করা হয়েছে -তারপরও যদি মানুষ যূথবদ্ধ হতে চায় তাহলে কঠোর আইন প্রয়োগের বিকল্প কি?
করোনা নিয়ন্ত্রণে আরেকটি বড়ো সঙ্কট মনে হচ্ছে করোনাক্রান্তদের সেবাদানকারী চিকিৎসক/নার্সদের প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষা সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা। খোদ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআরবি) -এর অনেক স্টাফ আক্রান্ত হয়েছেন। সিলেটের ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার মইন উদ্দিন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এছাড়াও আরোও অনেক ডাক্তার, স্বাস্থ্য সেবাকর্মী, নার্স, করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। ডাক্তারদের করোনা আক্রান্তের হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)। কার্যকর পিপিই (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট)-এর অপর্যাপ্ততা এর অন্যতম কারণ বলে ধরে নেয়া যায়। স্বয়ং চিকিৎসক ও নার্স যদি সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থা না পান তাহলে তারা করোনা আক্রান্তদের সেবা কিভাবে দেবেন?
তবে বাংলাদেশের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রী নিজেই অহর্নিশ করোনা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন, দলীয় নেতাকর্মী সবার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সর্বশেষ তথ্যাদি সংগ্রহ করছেন। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরাসরি প্রয়োজনীয় ডিরেক্টিভস দিচ্ছেন। মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। অযথা ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে সাহস-সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। নিহত ডাক্তারের পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন-আবার দায়িত্ব-বিমুখ পলায়নপর চিকিৎসকদের সতর্ক করতেও ভুলছেন না। তবে সবচাইতে বেশি চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো- এই বৈরী করোনাকালে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া দিন মজুর কিংবা দুঃস্থ অসহায় মানুষদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর দুঃচিন্তা। ঘরে ঘরে ত্রাণ পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন আবার ত্রাণ তছরূপকারীদের কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি দিচ্ছেন। স্বল্পমূল্যে চাল পাওয়া রেশন কার্ডের আওতাভুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে দ্বিগুণ করছেন।
তবে করোনা সঙ্কটের কারণে বিশ্বের যে অনিবার্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে ধরে নেয়া যায়। বিশ্বব্যাপী লক ডাউন ব্যবস্থার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম থেমে যাবে এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরে বিরাট হুমকি আসবে। বিশ্ব বাণিজ্য পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়বে। জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন এজেন্সির হিসেব মতে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ২ ট্রিলিয়ন ইউ এস ডলার লোকসানের শিকার হবে এবং করোনা কবলিত প্রায় সকল দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার কবলে পতিত হবে। ১৯৩০-এর মহা অর্থনৈতিক মন্দা এর পর ২০০৭-২০০৮ সালে মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো চাহিদার পতন। কিন্তু করোনা-জনিত কারণে সৃষ্ট মন্দা ঘটবে চাহিদা এবং যোগান উভয়ের যুগপৎ পতনের কারণে, যা হবে অনেক বেশি বিধ্বংসী। লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকুরী হারাবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ, সেখানে লক ডাউন দশা দীর্ঘায়ত হলে এবং তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন থমকে গিয়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই অস্থিরতার প্রভাব পড়বে চাকুরীর বাজারে। আইএলও-এর হিসেব মতো করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী তিন মাসে বিশ্বে সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ চাকরীচ্যুত হবে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশেগুলো সাড়ে বারো কোটি এবং এর অভিঘাত বাংলাদেশেও পড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর একজন চাকুরী হারানো মানে একটি পরিবার বিপদাপন্ন হওয়া। ইতোমধ্যে খোদ মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সেখানেও চাকুরীচ্যুতি শুরু হয়েছে। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকের চাকুরীচ্যুতির সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। এই পরিস্থিতি হবে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো।
সবদিক বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতির সাময়িক এবং স্থায়ী উত্তরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। লক ডাউনের কারণে কাজ হারানো দিন মজুর, রিক্সা চালক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক প্রভৃতি পেশার মানুষদের জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে সমাজের বিত্তবান মানুষেরা এগিয়ে আসছে ত্রাণ কার্যে যা হয়তো তাৎক্ষনিক সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। করোনা পরিস্থিতির আর্থিক অভিঘাত থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ৭২,৭৫০ কোটি টাকার, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বিদ্যামান অবস্থার উত্তরণে কেবলমাত্র সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবেনা। সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একদল মানুষ মহামারির অনুষঙ্গ হিসেবে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনাতে চাইছে। সেই চুয়াত্তর স্টাইলে বাসন্তী নাটকের মহড়া করতে চাইছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জামায়াত নেতা মওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাযায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে লক্ষাধিক মানুষের সমাগমের মধ্যে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর সমাবেশের গন্ধ পাওয়া যায়। মহামারির পরিস্থিতি পুঁজি করে এরা সেই পুরনো রাজনীতি চলাতে চায়। এরা দেশের শত্রু। বুঝতে হবে এই পরিস্থিতি কারুর একার সৃষ্টি নয়। এককভাবে কেউ দায়িও নয়। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানী, স্পেন, চীনের মতো দেশও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা সে তুলনায় এখনও ভাল। তবে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।
এই মহাদুর্যোগের মোকাবেলায় অনেকগুলো কাজ আমাদের একসাথে করতে হবে। যে কোনো মূল্যে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণ রুখে দিতে হবে। দক্ষতা পেশাদারিত্বের সাথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সবাই মিলে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। গজদন্ত মিনারে বসে রাজা-উজির না মেরে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে শত্রুনিধন করতে হবে। সমালোচনা না করে দৃশ্যমান কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আর তাৎক্ষনিক বিপদের চাইতে বড়ো বিপদ আসতে পারে ভেবে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা চলবে না। সামাজিক দূরত্বের শর্তাদি মেনেও খেতে-খামারে কাজ করা যায়। বোরো কাটার এই ভরা মৌসুমে সংগনিরোধ কৌশল বজায় রেখেই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে ক্ষমতায়িত করতে হবে।
আতঙ্কিত হয়ে কিংবা আতঙ্ক সৃষ্টি করে করোনার হাত থেকে নিস্তার মিলবে না । সচেতনতা, সাবধানতা এবং বিচক্ষণতার মধ্য দিয়েই করোনা সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হবে। প্রচণ্ড জীবনবোধ এবং প্রবল আশাবাদই পারবে করোনার অন্ধকার মেঘের কিনারে রূপালী রেখার ঝিলিক দেখাতে। রাত যতো গভীর ভোর ততোই আসন্ন। বাঙালি একাত্তরে একবার গর্জে উঠেছিলো দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে। এখন আরেকবার গর্জে উঠবে দেশ তথা মানবজাতির শত্রুর বিরুদ্ধে। ভয়াল করোনাকালের অবসান সময়ের ব্যাপার মাত্র।
করোনার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হলেও তা শিক্ষাও কম দিচ্ছেনা। কর্পোরেট পুঁজির এই নিষ্ঠুর সময়ে ব্যক্তিস্বার্থ আর মুনাফার পেছনে ছোটা মানুষগুলোর রাস টেনে ধরেছে করোনা- অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য। আমরা ভুলেই গিয়েছি শেষ কবে অলস দুপুরে একটু ভাতঘুম দিয়েছিলাম, কিংবা বিছানায় শুয়ে মাসুদ রানা পড়েছিলাম, কিংবা বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিয়ে সস্তা আড্ডায় মেতেছিলাম। করোনা আমাদের অন্তত দম ফেলার ফুরসতটুকু দিয়েছে। লকডাউনে বসেও প্রিয়জনদের ভার্চুয়াল সান্নিধ্যের উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছে। ভেবে ভালো লাগছে, বিশ্বের পরম পরাক্রমশালী দেশগুলো কিরকম ন্যাজ গুটিয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে বিশ্বকে চোখের পলকে ধ্বংস করার সামরিক শক্তি যখন করায়ত্ত, তখন এক সুন্দর সকালে অবাক বিস্ময়ে দেখল সামান্য এক জীবাণুর কাছে মানুষ কতো অসহায়। কতো সীমিতই না তাদের শক্তি প্রকৃতির কাছে।
এই উপলব্ধি আজ বড্ড প্রয়োজন। যান্ত্রিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষ প্রকৃতির ওপর বলাৎকার করেছে- সবুজ শ্যামল প্রকৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে- আর তাই বিশ্ব এখন উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। উষ্ণায়নের কারণে তুন্দ্রা, সাইবেরিয়া কিংবা আলাস্কা অ লের বরফ গলতে শুরু করেছে। সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে পুঞ্জিভূত এই বরফ স্তূপের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে করোনার মত আরো কতশত অণুজীব তার হিসেব কে রাখে। সেসবের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বিশ্বকে শান্ত রাখা, নিজেকে শান্ত থাকা। একটি পারমানবিক বোমা তৈরির জন্য যে ব্যয় হয় তা দিয়ে কোটি কোটি গাছ লাগানো যেতে পারে। বনায়ন করা যেতে পারে। তাই সময় এসেছে মানবজাতিকে এক সাথে কাজ করতে হবে, সাসটেইনেবল ডেভলেপমেন্ট গোল-১৭-তে যে পার্টনারশিপের কথা বলা হয়েছে তার মাহাত্ম্য অনুধাবন করে, করোনা প্রতিকারের উপায় খোঁজার পাশাপাশি করোনার কারণ খুঁজে তার মূলৎপাটন করা। পৃথিবীকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ রাখা। পৃথিবী নামক এই মাদার প্লানেটে হোমো সেপিয়ানসের টিকে থাকার প্রথম যোগ্যতা হলো- প্রকৃতিকে মিত্রজ্ঞান করা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে চাইলে, প্রকৃতি তো প্রতিশোধ নেবেই। মাবনজাতির অস্তিত্ব নিয়ে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ম্যালথুসের সতর্কবার্তা ফলছে কিনা কে জানে?
ড. রাশিদ আসকারী বাংলা-ইংরেজি লেখক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব উপচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড