শফিক মুন্সি
বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে। ক্ষুদ্র জীবাণুটি মাত্র কদিনেই কেড়ে নিয়েছে লাখ খানেক মানুষের প্রাণ। এসময় নিজেকে বাঁচাতে অন্যের প্রতি বৈরি হবার মতো স্বার্থপর সত্যের দেখা মিলছে আশেপাশে তাকালেই। তবে নিরাপত্তার অযুহাতে অমানবিক হবার চিত্রের উল্টো উদাহরণও সৃষ্টি হচ্ছে এই সমাজে।
নিজের চিন্তা না করে মানুষের জন্য মানুষের মাঝে কাজ করে যাচ্ছেন বরিশালের কয়েকজন। তারা হচ্ছেন শের-ই-বাংলা হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বিভূতি ভূষণ হালদার, বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী।
গত ২৯ শে মার্চ থেকে বরিশাল বিভাগের একমাত্র করোনা পরীক্ষাগার শের-ই-বাংলা হাসপাতালে শুরু হয় রোগ নির্ণয় কার্যক্রম। রোগীর দেহে করোনা জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য সেখানে কর্মরত ৫ জন টেকনোলজিস্টের নাম তালিকাবদ্ধ করা হয়। ৪ জন বিভিন্ন অযুহাতে তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নিলেও রয়ে যান বিভূতি ভূষণ হালদার।
সেই থেকে আজ অবধি জীবন নাশের শংকা জেনেও একাই রোগীদের করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন । আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকলেও সন্দেহভাজন রোগীদের খুব কাছে থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি। তাঁর এমন অবদানে তাই পরিচিত অপরিচিত অনেকের কাছেই পাচ্ছেন ' আসল নায়ক' হবার খেতাব।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা.বাকির হোসেন বিভূতির এমন সাহসিকতায় তাকে উপাধি দিয়েছেন 'করোনা যুদ্ধের বীর সৈনিক' হিসেবে। বিভূতি ভূষণ হালদারের এই অবদানে গর্বের কথাও জানালেন নিঃসঙ্কোচে৷
বরিশাল নদী বন্দর ও নৌ টার্মিনালে জনা শতেক ছিন্নমূল ভাসমান মানুষের নিয়মিত বাস। সম্পর্কের পরিচিতি হারানো এই মানুষ গুলোর সঙ্গে নিজের অজান্তেই অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়েছিলেন একজন। তিনি নদী বন্দরের সরকারি কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু।আর এই বাঁধনের শক্তি যে মরণঘাতী জীবাণুর চেয়েও শক্তিশালী তা তিনি টের পেলেন করোনা সংকট শুরু হলে।
দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হলে বিপাকে পড়ে ছিন্নমূল আর ভাসমান ঐ লোকগুলি। সাধারণত ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা কুলিগিরি তাদের বেঁচে থাকার পেশা। মানুষজন ঘরবন্দী হবার পর তাদের আয় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া চাল কিংবা চুলো দুটোর একটিও না থাকায় রান্না করে খাবার তাদের কোন সুযোগ ছিল না। এমন অবস্থায় ক্ষুধার তাড়নায় দিশেহারা হবার উপক্রম হয় তাদের।
ঐ পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে প্রতিদিন একবেলা খাবার বিতরণ শুরু করেন আজমল হুদা মিঠু। প্রথমদিকে ৮০-১০০ জন ছিন্নমূল মানুষের আহার যোগালেও সংখ্যাটা ২০০ তে পৌঁছাতে দেরি হয় নি। তবে পিছিয়ে যান নি নদী বন্দরের এই কর্মকর্তা। রান্না করা খাবার বিতরণের ২২ তম দিনেও হাসিমুখে লড়ে যাচ্ছেন একা।
পুরো দেশেই করোনার বিরুদ্ধে যখন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ শুরু হয় নি তখন থেকেই বরিশালে করোনার ভয়াবহতা তুলে ধরে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী৷ সরকারি ভাবে লকডাউনের ঘোষণা আসার আগেই বরিশাল নগরীতে জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানো ও নগরবাসীকে বিনামূল্যে মাস্ক-গ্লভস বিতরণ করেন তিনি।
লকডাউন শুরু হলে বুঝে গিয়েছিলেন নগরীর নিম্নশ্রেণীর মানুষের ক্ষুধার কথা। পাশে দাঁড়ালেন 'এক মুঠো চাল' নামে অভিনব কৌশল নিয়ে। মানুষের দানকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্রাণ তিনি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেন জরুরী খাদ্য সহায়তা হিসেবে। তৈরি করলেন 'মানবতার বাজার'। রেশনিং পদ্ধতিতে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা সেই বাজার থেকে বিনামূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিতে পারবেন।
শুধু এগুলোই নয়। মোবাইল ফোনে চিকিৎসা সেবা দেবার কথা চিন্তা করে শুরু করলেন 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেল'। সেখানে যুক্ত করলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরকেও। ঘরে বসেই সবাই যেন যেকোনো চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ পেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করলেন। সেখান থেকেই ২৪ ঘন্টা বিনামূল্যে করোনা কিংবা জরুরী হাসপাতালে নেবার মতো রোগীদের জন্য শুরু করেছেন এম্বুলেন্স সার্ভিস।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে তিনি এতকিছু করলেন সরকারের কোনো পর্যায়ের অংশ না হয়েই! শহরে যখন সরকার দলীয় রাজনৈতিকদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না প্রধান বিরোধী কিংবা ধর্মীয় দলীয় কাউকে। তখন ছোট্ট একটি দলের পেশী কিংবা অবৈধ অর্থ শক্তিহীন একজন নারী রাজনীতিবিদের এসব কার্যক্রম চোখকে স্বস্তি দেয়, মনকে শান্তি দেয়।
লাখো মানুষের এ শহরে এই মানুষগুলো লিখে চলেছেন মানবিকতার অনন্য উপন্যাস। যা হয়তো ইতিহাস হয়ে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। বৈশ্বিক এ মহাযুদ্ধে জয়ী হলে তাদের কথা উল্লেখ করেই কেউ বলে বসবে, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"। কারণ মনুষ্য অস্তিত্ব সংকটে ফেলে যখন অদৃশ্য জীবাণু প্রাণ কেড়ে নেওয়ায় ব্যস্ত। তখন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে শেখানো বিভূতি, আজমল আর মনীষারাই মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয়।
লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড