• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : আততায়ী মৃত্যু এক

  নিঃশব্দ আহামদ

১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৫৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

একটা আরশোলার উড়াউড়ি দেখে দেখে ঘুমবিরক্ত রাতের বেড়ে চলে বয়স। সে কবে থেকে চেষ্টা চলছে ঘুম আয়োজনের নামে এপাশ-ওপাশ চেষ্টা। কখনো জবুথবু লেপ মুড়ে থাকা, কখনোবা বসে থাকা। পুরো প্যাকেট সমেত সিগারেট শেষে আর বাকি আছে তিনটি। ছাই গন্ধে উশকো-খুশকো এক অনুভুতি। বুকের ওপর শাদা কাগজের প্যাডখানি রেখে এবড়ো-থেবড়ো চালিয়ে চলে কলমের টান। কখনো ভাবছে একটা লিখে ফেলি সুসাইড নোট! যখন ভোর হবে অনিমা নামের তিনটি অক্ষরের ভেতর পৃথিবী ত্যাগের সমস্ত সম্মোহন রেখে পলায়ন হয়ে যাবে অনিন্দ্যের সমস্ত প্রতিদিনকার রাত।

মানুষের ভেতরটা নিভৃতে কেঁদে চলে যার কিঞ্চিৎ প্রকাশ হয়তো চোখজলে যতোটা প্রকাশ পায় তার চেয়ে বেশি স্রোতে দুমড়ে মুচড়ে যায় ভেতরদেশ। সে এই ক’দিনে অনিন্দ্য ভালো বুঝতে পেরেছে৷খুউব ইচ্ছে করে ঘুমোতে গেলে আর ঘুম হয়না, অনিমা এখন কি করছে ঠিক?তার চোখের গগলসে এখনো কি ঝরে পরছে বিম্বিত আনন্দ, উচ্চাসের৷লিখে চলছে কি রাত জেগে কোনো কবিতা। ইতিউতি ভাবনা চাপিয়ে রাত বাতি জ্বলে গেলে অনিন্দ্যের খুব কান্না হয়। অনিমা ও কি বুঝে গেছে এভাবে রাতের পর রাত জেগে জেগে একদিন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে অনিন্দ্যের সময়? প্রশ্নবিদ্ধ কতেক অনুভূতির প্রার্থনা রেখে বারবার তাকিয়ে থাকে নিঃসাড় দেয়ালময়। টিকটিকি দুটি পালাক্রমে ঊর্ধ্বগামী হবার বারংবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একই বলয়ে৷জীবনটা একটা বলয়ের ভেতর যেনো কেটে গেলো অযুত ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতার নামে এতোটাকাল৷এসব ভেবে ভিজে যায় চোখ সহসায়৷

মানুষের ভেতরকার কোনো শক্তি থাকে যা তাকে বেঁচে উঠতে ভূমিকা রাখে আবার এমনও শক্তি থাকে স্বেচ্ছা মৃত্যুতে এই যে নিয়ত শোকগ্রস্থতা কাটিয়ে উঠার মোক্ষম পদ্ধতি হিশেবে। এপিটাফ খসড়ারচে চলে অনিন্দ্যও কারণে অকারণে সব রাতে, হয় তো অনিমা যখনিই নিঃস্বর থাকে, অনেক ডাকাডাকি শেষে অনিমার কোনো ইশারা না পেলে অনিন্দ্যের মনে হতে থাকে এই পৃথিবীতে বোধয় আর কোথাও এতটুকু অপেক্ষার শেষতকও আর নেই৷হতাশার গানে জেগে ওঠে পলায়ন প্রার্থনা। যদি আসন্ন সকালটিই শেষ কোনো সকাল হয় আর দ্যাখা হবেনা অনিমার চোখের কাজলে আঁকিবুঁকি টান, স্লিভলেসে উচ্ছল কোনো স্কুল ঘর, দুপুরের এপল সিডসের মিশেল খাবারের আনন্দ। আরমান, মুক্তা, তুষি নামের অনবদ্য ভরাট উচ্চারণে ডেকে যাবে না আর কোনো বিকেল-ঘরের অলস বিশ্রাম।

কাকভোরে জাগবেনা ভেবে আর কোনো চোখে পুরোটা দিনের একটা সারসংক্ষেপ, কেমন অসহায় হয়ে উঠে চারপাশ, এই যে বিছানাঘর যেনো ছেড়ে যেতে থাকে সমস্ত উষ্ণতা, শীতার্ত এক অনুভূতি ছড়িয়ে গেলে সারা শরীরে ভেসে উঠে অনিমা মুখ, পরপর যেনো বলে যাচ্ছে, ঘুমিয়ে যা সোনা, ঘুমিয়ে যা, আমার কোনো কথায় রাখিস না! শরীর খারাপ করবে যে। এই স্বরগুলো কেমন দ্যোতনা করে ফিরে, সমস্ত অন্ধকারের ভেতর যেনো এতটুকু উদ্ভাসে জাগে একখানি মুখ যেখানেই যাপনের তাবৎ সুখ লিপিবদ্ধ করে গেছে ঈশ্বর অনিন্দ্য নামে অপার কৃপায়৷ভাবনার সব ফুল এভাবে ঝরে ঝরে মৃদু মন্থর গতিতে রাত এগোতে থাকে কাঁটাছেঁড়া জীবনের কাছে, যেখানে ছিলোনা কোনো আনন্দ, শুধু ব্যথাবিদ্ধ এক হৃদয় খুঁজেছিলো এতটুকু স্বস্তিসম্ভার অনিমা মুখে।

অনিমা যেনো এতটাকাল এখানে ছিলো, এখন কেমন করে তার একটা স্কুলঘর হলো, তার সান্ধ্যপথে এখন আমার অপেক্ষা জমে থাকে! এই ঠাণ্ডা রাতে লাল শাল জড়িয়ে পথময় ত্রস্ত পায়ের ছন্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে পথ, সামনের কোনো বাঁকে সে উঠে যাচ্ছে, একটু পরই আবার সিঁড়ি মাড়া আওয়াজ, সে একাকী ঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে আছে তার বিন্যস্ত চুল বেখেয়ালে৷ হয়তো সে ভেবেছে কেবল সময় যাপনের একটা বিনোদনের মতো রোজকার এই কথালাপ, অথবা কোনো গল্পের প্লট আশ্রয়৷সে ক্ষোভে, বিদ্রূপে, অভিমান, অনুযোগে সে সরে যেতে থাকে পথ বদলের মতন, অথচ আমি পথ বদলের গান শিখতে পারিনি বরং অনিমার অস্ফুট কথা পড়ে পড়ে শিখেছি অপেক্ষা পাঠ, ভাবতে থাকে অনিন্দ্য।

কখনো অনিন্দ্য ভেবে চলে এই নো ম্যান্স ল্যান্ড অতিক্রম করে দীর্ঘপথ পাড়ি জমিয়ে ক্লান্ত হয়ে দুপুর রোদে জেগে উঠবে অনিমার শহর। কল্পনাশ্রয় আর ভবিতব্য অসাড় ভাবনা যাই বলি না কেনো, অনিমার বুকে বুক রেখে গ্রীবা ছুঁয়ে ক্রমাগত কেঁদে যাবার কোনো তাড়না তীব্র হতে থাকে আমার ভেতর, নিজ থেকে এসব ভাবতে থাকে অনিন্দ্য৷স্নানঘর থেকে ভেজা চুলের ঘ্রাণে মদিরতা এনে কবে যে সয়লাব কোনো মাতাল গন্ধাকুল দিনে যুগপৎ রচে ছিলো অভিসার, সে ভাবনায় আঁধারে হারিয়ে গেছে জীবনের এতোটা সময়।

এভাবে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে বাড়তে থাকে রাত, জড়োসড়ো হয়ে চাপিয়ে নিলে লেপ অনিন্দ্যের কেমন শীত শীত লাগে, না,এ শীত কিন্তু ভেতরের কোনো কুয়াশার, যেখানে শূন্যতার কোনো অতৃপ্ত বুকে শুধু নির্গত হতে থাকে বেদনার নীল ঘাম, তা অস্থিমজ্জায় যেনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে এবার নিশ্চিত একটা অসুস্থতার প্রকোপ তাকে আড়ষ্ট করে। এটাও পুরনো কোনো রোগের মতো, তাকে আর ভাবিয়ে তুলেনা এই পীড়ন৷কতোকাল এ চেম্বার ও চেম্বার ঘুরে গিলেছে হরেক ঔষুধের ডোজ তার ইয়ত্তা নেই। এখন বরং বিষাদ গরলে এমনো রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে এভাবে কাটিয়ে দিবে তবু ঔষধ না৷আর তা ভেবেও কেনো জানি দু’চোখ সমানে ভেসে যায় জলের ফোয়ারায়। এই অনিমা, তুমি দ্যাখছো না, এখনো জেগে আছি! খুব কষ্ট হচ্ছে আমার, এসব বিড় বিড় করতে তার শ্রবণেন্দ্রিয়ায় সাড়া পড়ে যেনো অনিমার উষ্ণ কোনো নিঃশ্বাস কিংবা স্বর, এই তো পাগল, আমি আছি, তোর হাতপায়ে, দ্যাখ ছুঁয়ে দ্যাখ। অশরীরী না তো!

সম্বিৎ এলে ভালো লাগে, ভেবে এমনও কল্প-বিলাস, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে যে এখানে ছিলো আয়োজন, অনেকটা পথ হেঁটে যাবার,হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হবার৷দিনশেষে বিকেল পথে কোনো অন্ধকারে আড়ালে জড়িয়ে থাকার অনেকটা ক্ষণ,একাকার হবার আনন্দ।

অনেকটা তন্দ্রায় হারিয়ে গেলে চোখ পরতে নেমে আসে একটা ভোর, কাকসব কা কা রবে উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমাকাশে৷একটা জংশন৷ভোরের কোনো ট্রেনে এই একটা শহর৷এখানে দূরবাসী একটা মুখের অপেক্ষা । দুপুর গড়ায়। বিকট হুইশেলে থেমে গেছে একটা অটো। প্রৌঢ় চালক খুলে দিলে বামের কোনো দরোজা, নেমে আসে অনিমা৷চোখে ঝুলে থাকে গগলস৷বেশ মানিয়েছে স্লিভলেসে আজ তাকে৷সদ্য গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠাধরে এখনো জমে আছে চুম্বন সুষমা৷তারপর অনিন্দ্য বাড়ালেই পা, জড়াজড়ি বুকে থেমে থাকে অনেকক্ষণ নিঃশ্বাস৷নির্বাক, গোঙানি হয়ে গেছে অনেকটা।

ঘুম ভেঙে গেলো বিকট শব্দে৷দূরে কোথাও কুকুরগুলো সমানে ডেকে যাচ্ছে। আষাঢ়ে রাত৷শোঁ শোঁ শব্দ তুলে বাতাস। এমন আঁধারই রাত, ভয়ার্ত চারিপাশ৷কোথাও যেনো বিলাপের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অদুর থেকে কোনো কান্নার শব্দ গোঙানি হয়ে ফিরছে অনিন্দ্যের। অনেকক্ষণ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর শার্সি থেকে জলের ঝাপটা এসে লাগে মুখে৷মোমের আলোয় সে জল আঠালো হয়ে কেমন অস্বস্তি ভারি করে তুলছে।

ভাবতে থাকে অনিন্দ্য। ঠিক কি সম্পর্ক অনিমার সাথে তার৷যদি না এতো এতো কান্নার রাত পেরোনোর পরও গড়ে না উঠে একই আকাশ, একই ছাদ৷অনিমা টা অনেক দূরে৷সস্তা প্রেমের গল্প বুনে বুনে আর যাই হোক জীবন চলেনা। বরং ভুলে যাবো। তবু ভুলে থাকা যাচ্ছেনা। তার কান্না পায়,এতোটুকু স্পর্শের। কখনো অস্থির হয়ে পড়ে প্রবল কামনায়৷তবু অনিমার পথ ফুরোয় না, ডিসেম্বরও আর আসেনা। বড়দিনে স্কুল ছুটি পড়বে৷দুজনে দূরে কোথাও যাবো, শরীরে শরীরে জমে যাবে কোথাও সংসার। অনিমাকে বুঝায় যায় না, দু’সন্তানের জননী।

অনিন্দ্যের মনে হতে থাকে অনিমা এখনো দু কিলো সাইকেল চালিয়ে আসছে৷তার রূপ সৌষ্ঠবে ও পাড়ার ছেলেরা হা হয়ে তার রূপ চাখছে। ভাবনার বিস্তৃতি শেষে সেও যেনো তাদের সম্পর্কের ভেতর একটা সারসংক্ষেপ আঁকে। খুউব অসম এক প্রেম৷দো টানা প্রেম। তবু অনিমাটাকে খুব ভালোবাসি, ভাবতে থাকে অনিন্দ্য।

অনিমা এখন খুব ব্যস্ত৷সারাদিন স্কুল, পরীক্ষা, জিরক্স ইত্যাদি। তাই অনিন্দ্যর সাথে খুঊব একটা কথা হয়না। বুকদেশে তার চিন চিন করে উঠে ব্যথা। অনিন্দ্যের কান্নাভেজা চোখ দুটো বেশ সুন্দর৷সব ছেড়ে ছুঁড়ে তার কাছে চলে যাওয়া যায়৷আবার ভাবে অনিন্দ্যও তো আসতে পারে। কেনো আসেনা সে। দুজন দু’দেশর হয়েছে তো কি হয়েছে৷তাই বলে প্রেমে, কামে, অনুভবে থাকবে কেনো বারণ। ঝিমনো দুপুর ঘরে ঢুলতে থাকে অনিমা। মুঠোফোনটি হাতে নিয়ে অনিন্দ্যকে ফোন দিবে ভাবে৷তা আর হয় না।

অনিন্দ্য রাত-বিরাতে হাঁটে। রাতের আঁধারি শরীর তার খুউব প্রিয়। শূন্যতার একটা সহযোগ আছে আঁধারের সাথে। এসব রাতে সে হেঁটে হেঁটে সংসার করে, বাচ্চা এক বাবা বাবা বলে ডাকে। চাঁদের হাসির মতো সফেদ দাঁতে কখনো তার পাশ ধরে হাসে৷একসাথে সমুদ্র বিহার হয়৷বেলাভুমি তীর ধরে অনেক দুর যেতে যেতে গ্রীবায় ঝুলে থাকে অনিমার ওষ্ঠাধর৷কখনো অনিন্দ্য ভাবে এভাবে আর হাঁটা হবেনা, কোথাও বিচ্ছিন্ন মৃত্যু ঘটে! জাতির শোক ঘটে৷সরকারি ঘোষণা আসে শোকের। এমনও মৃত্যু আসতে পারে,কিংবা দাগি আসামি হতে পারে, সংশ্লিষ্টতা ছাড়া।

সবই সম্ভব এখানে। আবার কখনো অনিমাকে হারিয়ে ফেলে৷যেমন গুজবে একটা মানুষের প্রাণ সংহার করেও যেমন বিবেকের বালাই থাকে না এমনো আশংকা হতে থাকে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে ভরা মাঠে শুয়ে পড়ে অনিন্দ্য। রাতের করোটিতে ঝুলে চাঁদ৷আকাশ সভায় ঘনীভূত নৈঃশব্দ্য৷সে জলের শব্দ শুনে অকস্মাৎ। পাশ ফিরে তাকাই৷জটলা দেখে৷ছোট একটা নদী ওখানে। ঝিলের পাশ ধরে শান্ত স্রোত। হাঁটতে থাকে, আরও সামনে।

অনিন্দ্যের টলছে পা। ঘুম ঘুম পাচ্ছে খুউব। পশ্চাদগামি পা৷ভন ভন আকাশ, ঘুরছে টালমাটাল। এমন তো হয়নি কখনো আগে৷মাথার খুলি ভেদ হয়ে রক্ত আসে। ধারা হয়ে বেরিয়ে আসে। অনিমা হাসে, তার চোখে৷অনিমা, এসো। আর অপেক্ষা না৷আমার পিঠ চাপড়াও। চুলে বিলি কাটো। আমার আর এগোনো যাচ্ছেনা। তোমার পথে৷এসো। অনিমা এসো। কারা যেনো পালিয়ে যাবার শব্দ শুনে। মাঠে জুয়া বসে। সেতুর নীচে মদের আসর। চোরাচালান হয়। ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্ব হয়। কারও কারও স্বার্থদ্বন্দে মৃত্যু হয়। মানুষ গুলো পালাতে থাকে। অনিন্দ্য হাসে। অনিমা, ডিসেম্বরে আর আসা হচ্ছেনা। নিথর হয়ে পড়ে থাকে লম্বাকার অনিন্দ্য শরীর। সকালের রোদে খবর হয়ে উঠে পাড়া। আততায়ী মৃত্যু এক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড