• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাদিয়া আফরিন প্রমার চারটি অনুগল্প

  সাদিয়া আফরিন প্রমা

০১ জুন ২০১৯, ০৯:০২
গল্প
ছবি : সাদিয়া আফরিন প্রমার চারটি অনুগল্প

১ একটি ঈদ ও অন্তহীন অপেক্ষা

পারুলা হুড়মুড় করে উঠে বসল বিছানায়। কালকে রোজা শেষ হয়েছে। আজ খুশীর ঈদ। পারুলার অবশ্য তেমন কোন মাথাব্যথা নেইl এমন উপবাস বা আধা রোজা ওকে প্রায়ই করতে হয়। লোকের বাড়ি কাজ করে খায় ওl

আদরী আর রুসতুম দুই ছোট্ট ছেলেমেয়েকে খাইয়ে নিজের জন্য অনেক সময়ই কিছু থাকে না ওরl তার স্বামী রহমান সেই গতবছর থেকে নিখোঁজ। ইলিশের সময় ছিল l সব জেলে মাঝি ফিরে এলো, কিন্তু এলো না কেবল রহমানl পারুলার বুকের ভিতরটা সেই আগের খুশীর দিনগুলি, খুশীর ঈদের কথা ভেবেই হু-হু করে যন্ত্রণায়l আজ বাবুর বাড়িতে কতো আনন্দ। সবাই নতুন পোশাকে সাজবে। আর কতরকম সুস্বাদু খাবার, মিষ্টি কত কী। ওকেও একটা শাড়ি দিয়েছে ওরা। আর সে নুরু ভাইজান এর দোকান থেকে ধার করে ছেলেমেয়ে দুটোর জামা এনেছে।

পারুলার দুই চোখ জলে ভরে উঠলো। ও ভাবে আল্লাহ্ কোথায় আছেন? ও তো রোজ পবিত্র আত্মায় মনপ্রাণ ঢেলে নমাজ পড়ে, তসবিহ গোণে, কই তাঁর কানে কী ওর প্রার্থনা পৌঁছায় না? আবার ইলিশের মরসুম এসে গেল। রহমান এর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা ওর। ও স্বপ্ন দেখে, রহমান ফিরে এসে বলছে,‘কই গো আদরীর মা? কোথায় গেলা?আজ একখান বেশ বড় ওজনের ইলিশ পাইছি। বাজারে বেশ দর উঠব -দেইখো’

পারুলা দুই ছেলেমেয়েকে গোসল করিয়ে আজ সালমার বাড়িতে রেখে কাজে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল সন্ধ্যায় ওদের জন্য অনেক বরফি, মিষ্টি নিয়ে আসবে। ছোট্ট আদরী আর রুসতুম এর খুশী আর ধরে না আজ। সারাদিন ছেলেমেয়ে দুটোর জন্যে ছটফট করে গোধূলির রাঙা আলোয় বাড়ির পথ ধরল পারুলা।

আজ ছেলেমেয়ে দুটোকে পেট পুরে ভালমন্দ খাওয়াবে সে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ওর কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে গেছে ওl কিন্তু ওর ঘরের সামনে আবু চাচা ,ফতিমার মা আরও সবাই ভিড় করেছে কেন? ওরা কাঁদছে কেন? ওকে দেখামাত্র চুপই বা হয়ে গেল কেন? ভিড় ঠেলে ঘরে ঢোকে সে।

আদরী ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে। পারুলা কেমন যেনো কিছুই না বুঝে বলে,‘কী হয়েছে মা -কাঁন্দস ক্যান, রুসতুম কোথায়? এত্ত মাইনসে কী করতাসে? কার কী হইসে ? তোদের জন্য মিঠাই আনসি, আই মা। রুসতুম কই-ও খোকা -----’

আদরী মাকে জড়িয়ে কেঁদে বলল শুধু, ‘কারে ডাকো মা? ভাইজান বায়না কইরা রহিম চাচার লগে নদীতে গেছিল। ওরে পাড়ে রাইখা চাচা জাল ফেলতেছিল নদীতে। একসময় একখান হঠাৎ জলের তোড় আসে। কোনরকমে স্রোত সামলায়ে চাচা ঘুইরা দেখে ভাইজান পাড়ে নাই। বহু খুঁজ্যাও ওকে পাইনাই মা---"

হঠাৎ সব শূন্য হল আজ খুশীর ঈদে। এক নেহাতই অখ্যাত গাঁয়ের হতদরিদ্র মায়ের ঘরে। শুধু একটা চিৎকার মাতৃহৃদয়ের হাহাকার ছিঁড়ে কাঁপিয়ে দিল ঈদের আকাশ-বাতাস। ‘খোঁকা রে. . . ’ সব খাবার পারুলার অচেতন শরীরের হাত থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল মাটির ঘরে। আল্লাহ্ -র কাছে ইনসাফ -এর প্রার্থনায় খুশীর ঈদে পারুলার পাওনা হল আর একটা নতুন অন্তহীন অপেক্ষা।

পাঞ্জাবী

ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত নগরী। ছুটে চলেছে সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনে।

পড়া-লেখা করার জন্য গ্রাম থেকে শহরে এসেছে নয়ন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। শহরের মাটিতে পা রাখতেই ছিনতাইকারীরা সব লুটে নিয়ে যায়। কপালে হাত দিয়ে সেখানেই বসে পড়ে সে। বাঁচার তাগিদে কয়েকদিন পরে রিকশা চালাতে দেখা যায় তাকে। পকেটে থেকে নোকিয়ার বহু পুরোনো মডেলের ফোনটা বেজে ওঠে। নিশ্চয়ই বাবা ফোন করেছে। - সকালে কী খেয়েছিস খোকা? - গরম ভাতের সাথে ডিম ভাজি করেছিলাম বাবা।

কথা শেষ করে ফোনটা রেখে পকেট থেকে ১০০ টাকার কয়েকটা নোট বের করে আবার রেখে দেয় নয়ন। যা সে খেয়ে না খেয়ে জমিয়েছে। মনে মনে বলতে থাকে এবার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে যাবে, গত তিন বছর বাবা রহিম চাচার দেওয়া পুরোনো একটা পাঞ্জাবী পড়ে ঈদ করে। এসব ভাবতে ভাবতে আবার রিকশার প্যাডেল মারতে থাকে নয়ন। সকালে খাওয়া শুকনো বাসি একটা রুটি তখনও হয়তো পাকস্থলীতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল।

এক পথশিশুর ঈদ

দিনের শেষে রাত আর রাতের শেষে দিন। এভাবেই প্রতি রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চিরচেনা সেই ঢাকা শহরটি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠে। কোলাহলে মেতে উঠে পুরো শহর। এই কোলাহলে প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম ভাঙে জরির। ঘুমটা নিজ থেকে ভাঙেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে ওর অসুস্থ মা। জরি অবশ্য ঘুমাতে খুবই ভালোবাসে। কেননা ঘুম ভাঙলেই ওর ক্ষিদের জ্বালাটা তীব্র হয়ে ওঠে যা ওর জন্য খুবই কষ্টদায়ক।

বয়স কতো হবে জরির? সাত বা আট। তবে এই বয়সে অন্যান্য শিশুর মতো পুষ্টিকর খাদ্য, ভালো পোশাক, খেলনা কিছুই সে পায়না। এসব কিনে দেয়ার সামর্থ্য তার মায়ের নেই। যদিও এ দায়িত্ব টা বাবার উপর থাকে। কিন্তু জরির পৃথিবীর পুরোটা জুড়ে শুধু ওর মা। জরিরও কিন্তু ভালো একটা পরিবার ছিল। জরির বাবা একটি চাকরি করতো। স্বল্প আয়ে তাদের সংসার খুব ভালই চলছিলো। কিন্তু জরির বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার বাবা তাদের রেখে চলে যায়। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য জরিকে নিয়ে পথে নামে তার মা। সেই তিন বছরের জরি আজ সত বছর বয়সি হয়ে গেছে। এখন জরি তার মাকে নিয়ে এই ঢাকাতেই কোনো এক ফুটপাতে রাতে মাথা গোজার ঠাই করে নিয়েছে।

বেলা বেড়ে যাচ্ছে। জরিকে এখনই একটি বস্তা নিয়ে বের হতে হবে। যদিও বস্তাটা তার তুলনায় বড়। ঘুরবে এই রাস্তা থেকে ওই রাস্তা। এই ডাস্টবিন থেকে ওই ডাস্টবিন। আমাদের শহরের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় ‘টোকাই’।

আজ ২৪ তম রোজা। জরি সাতটি রোজা রেখেছিল। অনেক কষ্ট হয়েছিল তার। সেহেরির সময় একটা শুকনো রুটির অর্ধেকটা ও খায় আর বাকিটুকু ওর মা। বাকি ক্ষিধাটুকু সে কল থেকে পানি খেয়েই মিটিয়ে নেয়। তারপর ইফতারির সময় শুধু পানি, আর মাঝেমাঝে ভাগ্যে জোটে একটি রুটি। বেশী কষ্ট হয় বলে ওর মা ওকে বাকি রোজা গুলো রাখতে দেয়নি।

রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাৎই একটি বড় শপিংমল এর দিকে জরির চোখ পড়ে। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে।ভেতরে নানান রঙের কাপড় সাজানো। জরি ভেতরে যাওয়ার সাহস পায়না। ময়লা কাপরে দেখলে যদি তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তবে সে নিয়ে জরির কোনো দুঃখ নেই। কাধে ঝোলানো বস্তা টার দিকে তাকিয়ে ভাবে, আচ্ছা ওগুলো বিক্রি করলে ২০ টাকা পাবো তা দিয়ে কি আমার জন্য একটা জামা কেনা যাবে?

নাহ থাক আমার জন্য না মায়ের জন্য একটা শাড়ী কিনতে.. পারলে হঠাৎই কারো চিৎকার এ জরির ভাবনায় ছেদ পড়ে। পেছনে তাকাতেই দেখে এক সাহেব তাকে বলছে, ‘এই টোকাই এর বাচ্চা এখানে কি? যা এখান থেকে।’ লোকটা ওকে তেড়ে মারতেও আসে কিন্তু গায়ে ময়লা কাপড় থাকায় জরি মার খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। সে মাথা নিচু করে হাটতে থাকে। গন্তব্য সেই ফুটপাত, মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে সে।

ফুটপাতে ফিরে মায়ের কাছে টাকাটা দিয়েই কংক্রিটের তৈরী ফুটপাতে একটি পুরনো ছেড়া কাথা বিছিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরে। চোখে ঘুম আর তার মাঝে বিরাজমান হাজারো স্বপ্ন। হঠাৎই শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে জরি। হ্যাঁ, আর কিছু নয়, তার মা তাকে ডাকছে, সকাল হয়ে গেছে। আবার জীবনযুদ্ধে নামতে হবে এই ক্ষুদে যোদ্ধাকে।

এমনি করেই এক একটা দিন শেষ হয় যায় জরির। মায়ের মুখে শুনেছে আগামীকাল নাকি ঈদ। রাস্তায় বের হয়ে জরি দেখে সবাই শেষ মুহূর্তে ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যস্ত। এসব দেখতে দেখতে জরির মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে জরি মার্কেট থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাস দেখতে থাকে। তার অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ কাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে জরি চমকে উঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে এক ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পিছনে ফিরতেই ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে নিবি? অমন একটা জামা।’ জরিকে কিন্না দিবো? আমার তো কেউ এ নাই মা ছাড়া। ছেলেটি বললো, ‘আয় আমার সাথে।’

ছেলেটি জরিকে নিয়ে মার্কেট এ ঢোকে। সেখানকারই একটি দোকান থেকে লাল টুকটুকে একটি জামা কিনে দেয় তাকে। জরি বুঝতে পারে না সে কি সপ্ন দেখছে নাকি সত্যি! ছেলেটার ডাকে ঘোর কাটে তার। জরির হাতে ৩০০ টাকা দিয়ে বলে এই নে, তোর মাকে বলবি আগামীকাল সেমাই রান্না করতে। বলেই ছেলেটি চলে যায়। জরি একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ছেলেটির চলে যাওয়া দেখে। ছেলেটি চোখের আড়াল হতেই জরি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে, অনেক অনেক খুশি সে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা যে ফুটপাতে রাতে ঘুমায় সেটার অনেকটা কাছে চলে আসে জরি। এখানেই তো ওর মা বসে থাকে। হয়তো ওর মা ওকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে একটু অবাক হবে। তাতে কি? সে আজ অনেক খুশি।

হ্যাঁ, জরি পৌছে গেছে প্রায়। রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য রাস্তায় নামে সে। রাস্তার ওপাশ থেকে জরির মা ও তাকিয়ে আছে জরির দিকে। কিন্তু আজকে তার চাহনিটা একটু অন্যরকম। যেনো অজানা এক আশংকায় ছেয়ে গেছে তার মন। হঠাৎই জরির মায়ের চোখদুটো অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যায়। জরি বুঝতে পারেনা কি হয়েছে, কেনই বা তার মা এভাবে তাকিয়ে আছে। কারণ খোঁজার চেষ্টা করে সে। তবে তার আগেই ছোট্ট জরির গলা চিড়ে বেরিয়ে আসে চিৎকার।

জরির মা অসুস্থ শরীর নিয়েই ‘জরিইইইইই’ বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসে। জরি রক্ত মাখা শরীরটা রাস্তায় পড়ে আছে। হাতে সেই ৩০০ টাকা আর রক্ত মাখা লাল জামা।

হ্যাঁ, একটু আগেই একটি মালবাহী ট্রাক জরিকে ধাক্কা দেয়। জরির রোগা শরীরটা ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ে রাস্তার উপড়। ট্রাকটি শুধু জরিকেই নয় বরং তার নতুন কাপড় পড়ে ঈদ করার স্বপ্নটাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আর এভাবেই ভেঙে যায় এক পথশিশুর স্বপ্ন।

৪ মূল্য

রফিক সাহেবের একমাত্র মেয়ে লামিয়া। খুব ছোট বয়সে মা হারা হয় মেয়েটা। মেয়েকে সবরকম সুখ দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। সারাজীবন মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি তিনি। তার সবটুকু জুড়েই ছিল তার মেয়ে,লামিয়া। চোখের সামনে সেই ছোট্ট মেয়েটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেল। রফিক সাহেব চেয়েছিলেন তার মেয়েকে ভালো কোথাও বিয়ে দিবেন। এক কথায় সুপাত্রে দান করবেন। অথচ সেই মেয়েই পালিয়ে বিয়ে করল, তাও আবার কোথাকার কোন নাম পরিচয় বিহীন এক ছেলেকে, দেখেই মনে হয় নিয়মিত নেশা করে।

নাহ, মেনে নিতে পারলেন না তিনি। নিজেকে নিজের কাছেই পরাজিত মনে হচ্ছিল তার। মেয়ে আর জামাইকে, ত্যাজ্য করলেন। তার কয়েক বছর পরেই পরপারে পারি জমালেন,আর সম্পত্তি পেল তাঁর ভাইয়ের ছেলেরা ।

বছর কয়েক পর. . . খদ্দের বের হয়ে যাওয়ার পর দুহাত দিয়ে টাকা গুনতে গুনতে মনে মনে ভাবে লামিয়া, নিজের ভালবাসার মূল্য না দিয়ে বাবার ভালবাসার কথা ভাবলে আজ পতীতালয়ের বাসিন্দা হতে হতো না তাকে!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড