• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মেশিনের চাকা ঘুরলেও ঘুরে না রাবেয়ার জীবন চাকা

  শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার

০১ অক্টোবর ২০২১, ২০:৪৫
সেলাই মেশিন
সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাচ্ছেন বিধবা রাবেয়া বেগম। ছবি : অধিকার

এক মুহূর্তের জন্যও যেন থেমে নেই তার সেলাই মেশিনের চাকা। বনবন করে ঘুরছে আর তার সাথে চলছে ধারালো সূচের ওঠানামা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা চোখদুটোর নজর সেই সূচের ওঠানামায় সেলাই পড়া কাপড়ের দিকে। এতটুকু হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। একটু পরপরই সূচের কাছাকাছি হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাপড় সোজা করে দিতে হয়। এই বুঝি গেঁথে যাবে তীব্র গতিতে ওঠানামা করা সুঁই! কিন্তু যায় না। অথবা যায় কখনো কখনো। তাতে তোয়াক্কা নেই... ঝুঁকি নিয়েই চলে তার সেলাইয়ের কাজ।

কথায় দকথায় অনেকেই বলেন, তিনি সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে স্বপ্ন বুনেন। সে বুননে তৈরি হয় সভ্যতা টিকিয়ে রাখার পোশাক-পরিচ্ছদ। অন্যের জীবনটাকে রঙ্গীন ও আনন্দময় করতেই তার টানা ঝুঁকিপূর্ণ পরিশ্রম। থ্রি-পিস, শার্ট এবং মেক্সি ও ব্যাগ সেলাই করেন। এসব পণ্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিজেই আবার বিক্রিও করেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, শীত কিংবা গ্রীষ্ম কোনো কিছুতেই তার কাজের রুটিনে যেন পরিবর্তন আসে না।

সেলাই কাজ চলে সময়ের কাটার সাথে তাল রেখে। কিন্তু এই যে কাজ, সেই কাজের আগেও থাকে তার কাজ। ঘর গৃহস্থলীর। সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে সেগুলো সেরে তবেই সেলাই কাজ।

বলছিলাম, একজন বিধবা নারী রাবেয়া বেগমের জীবন গল্প। এটাই তিন সন্তানের জননী রাবেয়ার দৈনন্দিন জীবনচিত্র। এমনই তার জীবনযুদ্ধ। দিন-মাস-বছর যায়, অনেক কিছুই পাল্টায়, শুধু পাল্টায় না রাবেয়াদের জীবনের গতিপথ। সাথে পাল্টায় না তার ভাগ্যও।

কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডেই পলিথিনে মোড়ানো ঘরেই তিন সন্তানের জননী বিধবা রাবেয়া বেগমের (৩০) বসবাস।

২০১৪ সালে সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য স্বামী মোহাম্মদ সিরাজ এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ স্ত্রীকে রেখে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। স্বপ্ন ছিল অভাবের সংসারে সচ্ছলতা আনবে। সুখে জীবন অতিবাহিত করবে। সেই সুখের আশা অধরাই রয়ে গেল রাবেয়ার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মালয়েশিয়ায় মারা যান স্বামী মোহাম্মদ সিরাজ। এতে করে অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় পুরো পরিবার। তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়ে যান রাবেয়া।

দিনে দিনে সন্তানদের বয়স বাড়ে, সেই সাথে লেগে থাকে অভাব অনটন। এমতাবস্থায় বিধবা রাবেয়া সন্তানদের আহার জোগাতে অন্যের বাড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ নেন। এতেও নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার। সেই যে শুরু হলো স্বপ্ন ভঙ্গ জীবনের যুদ্ধ, আজও সেই যুদ্ধ চলছে।

জানা গেছে, ইউনাইটেড পারপাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করে হতভাগী রাবেয়াকে। পরে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাসের সহযোগিতায় ইকরা প্রকল্পের আওতায় ৩৫ হাজার নগদ অর্থ অনুদান পান রাবেয়া। অনেকের মতো তারও সুযোগ মেলে সেলাই প্রশিক্ষণে। সেলাই কাজে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেন আইওএম এর অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস।

প্রশিক্ষণ পেয়ে ক্রয় করেন নতুন সেলাই মেশিন। এতে অসহায় হতদরিদ্র রাবেয়া বেগম ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে কাপড় সেলাই করা অর্থ দিয়ে রাবেয়া তার সংসারে খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। সেলাই মেশিনের চাকায় স্বপ্ন দেখছেন রাবেয়া বেগম।

দিনে দিনে কাজ বাড়ে, নিজেরও দক্ষতা বাড়ে তবে আয় বাড়ে না। সেই যে শুরু হলো ২৫ হাজার টাকায় যুদ্ধ। আজও সেই যুদ্ধ।

রাবেয়ার বড় মেয়ে জয়নাব আক্তার বলেন, আমার বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবা সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। কেউ খোঁজ-খবর রাখত না। মা তখন পরের ঘরে কাজ করে আমাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। মা-ই এখন আমাদের সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। সেলাইয়ের কাজ করে, তৈরি পণ্যগুলো গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে যে অর্থ পায়, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।

বিধবা রাবেয়া বেগম বলেন, আমার স্বামীর মারা যাওয়ার পরে আমি একা। পরের ঘরে কাজ করে এতবড় সংসার আমার পক্ষে চালানো কঠিন হয়ে যেত, অনেক কষ্ট হতো। বর্তমানে আমি ইউনাইটেড পারপাসের সহযোগিতায় থ্রি-পিস, শার্ট এবং মেক্সি ও ব্যাগ সেলাই করি। এসব পণ্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিজেই বিক্রি করে সংসার চালাই, সন্তানদের ভরণপোষণ করি।

তিনি বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যখন হারিয়ে ফেলছিলাম, ঠিক তখনই আলোর বার্তা নিয়ে জীর্ণ বাড়িতে হাজির আইওএম অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস। আমি ২০২০ সাল থেকে ইকরা প্রকল্পের মাধ্যমে শাপলা দলের সদস্য হয়েছি। অনেকের মতো আমিও সেখানে প্রতিমাসে একশত টাকা সঞ্চয় করছি। বর্তমানে এই শাপলা দলে আমরা ২৭ জন সদস্য আছি, যারা আমার মতোই।

স্থানীয় জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুজাম্মেল হক জানান, আমার ছেপটখালি এলাকায় রাবেয়া বেগমের মতো আরও অনেক গরীব ও অসহায় মানুষের পাশে ছিলেন আইওএম ও ইউনাইটেড পারপাস। তাদের মানবিক কাজের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এভাবে যদি অন্যরাও কাজ করে, অসহায় হতদরিদ্র মানুষের উন্নয়ন হবে।

আরও পড়ুন : ইয়াবার ‘নিরাপদ রুট’ পেকুয়া-টৈটং এবিসি আঞ্চলিক মহাসড়ক!

বিষয়টিতে জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী দৈনিক অধিকারকে বলেন, এ ইউনিয়নে আইওএম অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস ৩৫ হাজার টাকা সহযোগিতা করেছে রাবেয়াকে। তবে বিধবা রাবেয়া আরও সহযোগিতা পেলে অনেক বড়কিছু করতে পারতেন। রাবেয়ার মতো প্রায় সাড়ে পাঁচশত উপকারভোগীকে সহযোগিতা করেছেন আইওএম ও ইউনাইটেড পারপাস, তাদের আমার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজামুদ্দিন আহমেদ দৈনিক অধিকারকে বলেন, কক্সবাজার জেলায় অনেক এনজিও-আইএনজিও কাজ করছে। তবে ইউনাইটেড পারপাসের কর্মকাণ্ড অন্যদের থেকে ভিন্ন। আমি আশাবাদী রাবেয়ার মতো উখিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি সরঞ্জাম, কৌশল ও মূলধন হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করে তাদের উপকৃত করবে এনজিও-আইনজিওগুলো।

ওডি/নিলয়

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড