• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ইয়াবার ‘নিরাপদ রুট’ পেকুয়া-টৈটং এবিসি আঞ্চলিক মহাসড়ক!

  এস এম জুবাইদ, পেকুয়া, কক্সবাজার

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৪৭
সড়ক
ইয়াবার ‘নিরাপদ রুট’ হিসেবে পরিণত হয়েছে পেকুয়া-টৈটং এবিসি আঞ্চলিক মহাসড়ক। ফাইল ছবি

কক্সবাজার থেকে পেকুয়া হয়ে চট্টগ্রামে ইয়াবা পাচারের ‘নিরাপদ রুট’ হিসাবে ইয়াবা কারবারিরা ব্যবহার করছেন পেকুয়া-টৈটং আঞ্চলিক মহাসড়কটি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই পথে ইয়াবার চোরাচালান করে আসছে। পেকুয়া থানা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সড়কে চেকপোস্ট না থাকার সুযোগে এই রুট দিয়ে ইয়াবাগুলো বাঁশখালী হয়ে চট্টগ্রামে পাচার করতে গিয়ে আবার কেউ কেউ পেকুয়ার সীমান্ত পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ফুটখালী ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় বাঁশখালী থানা প্রশাসনের বসানো চেকপোস্টে গিয়ে ধরা পড়ছে। এভাবেই প্রতিনিয়ত ইয়াবা চালান করে আসছে পেকুয়ার বেশ কয়েকটি ইয়াবা সিন্ডিকেট।

দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট বেপরোয়া ইয়াবা চালান দিলেও এখনো তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পেকুয়া থানার পুলিশ মাদক উদ্ধারে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরও ইয়াবা উদ্ধার ও সংশ্লিষ্টদের আটক করতে না পারায় মাদক কারবারিরা ইয়াবা বিক্রি করে যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ফলে এখন রীতিমতো মাদকের অভয়ারণ্য পরিণত হয়েছে পেকুয়া। হরহামেশাই ইয়াবার চালান অব্যাহত রয়েছে। আর এই ইয়াবা চালানের টার্নিং পয়েন্ট পেকুয়া-চৌমুহুনী সিএনজি স্টেশন।

এ ছাড়াও পেকুয়ার ইয়াবা কারবারিরা টৈটং সড়ক হয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা পাচার করতে গেলে পুলিশ কারবারিদের নাগাল না পেলেও পেকুয়া সদর চৌমুহনীস্থ মোড়ে সিএনজি সংগঠনে জড়িত কয়েকজন ব্যক্তি তাদের গতিরোধ করে ইয়াবার চালান ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে।

এ দিকে, সম্প্রতি পেকুয়া সদর ইউপির বাইম্যাখালী থেকে চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে আনোয়ারায় গিয়ে ধরা পড়ে তিনজন ইয়াবা কারবারি। এ ছাড়াও বিগত কিছুদিন আগে জেলা ডিবি পুলিশের অভিযানে পেকুয়ার উজানটিয়া থেকে ১ লাখ ১৬ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের পাশাপাশি দুইজনকে আটক করলেও এ ক্ষেত্রে থানা পুলিশের ছিল নীরব ভূমিকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুই মাসে বাঁশখালী থানা পুলিশের অভিযানে পুঁইছড়ি ফুটখালী ব্রিজ সংলগ্ন চেকপোস্টে ১৫টি পৃথক অভিযানে মোট সাড়ে ৬৮ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এই সময়ে কক্সবাজার আর চট্টগ্রামের নারী-পুরুষ মিলিয়ে বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারিও গ্রেপ্তার করে তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাঁশখালীর ফুটখালী ব্রিজ সংলগ্ন চেকপোস্টে যে সমস্ত ইয়াবা পুলিশের হাতে জব্দ ও কারবারি আটক হয়েছে তারা নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করেছে পেকুয়া-টৈটং এবিসি আঞ্চলিক মহাসড়ক। পেকুয়া সড়কে নজরদারি না থাকায় বাঁশখালীতে গিয়ে ধরা পড়েছে ইয়াবাগুলো। এরই মাঝে পেকুয়া থানা পুলিশের কার্যকর অভিযান না থাকায় অল্প কয়েকজন ইয়াবা কারবারিদের কৌশলে আটকিয়ে চৌমুহনী সিএনজি স্টেশনের দুইজন লাইনম্যান বিভিন্ন সময় ইয়াবা ছিনতাই করে বহু টাকার মালিক বনে গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ- এই পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রাখার কারণে কিছু মাদক কারবারি খুচরাভাবে পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। মাদকসেবীরা ভয়ংকর এ মাদক সেবন করে চুরি আর ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কিশোর বয়সের বেশ কয়েকজন ইয়াবা সেবনকারী কিশোর গ্যাং তৈরি করে দিনে-দুপুরে সড়কে চলাচলকারী লোকদের কাছ থেকে মুঠোফোন ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে।

সচেতন মহলের দাবি, ইয়াবা ভয়ংকর এক মাদক। যুব সমাজ তা সেবনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। পেকুয়ার বেশ কয়েকটি পাড়া-মহল্লায় খুচরাভাবে ইয়াবা বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। এ ছাড়াও পেকুয়া-টৈটং সড়কে পুলিশের চেকপোস্ট নিয়মিত হলে মাদক কারবারিরা ইয়াবা পাচার করতে ভয় পাবে।

এ দিকে, পেকুয়ার বেশ কয়েকটি আলোচিত পয়েন্টে এখন জমে উঠছে ইয়াবার স্বর্গরাজ্য। পেকুয়া উপজেলাজুড়ে রয়েছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা। এটি এখন দ্বিতীয় টেকনাফে রূপ নিচ্ছে এই অঞ্চল।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়নে ইয়াবার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট উঠে এসেছে। এসব ইয়াবা চালান পাচার করতে উপজেলাজুড়ে রয়েছে একটি বড় সিন্ডিকেট। তারা কক্সবাজার থেকে চকরিয়া পেকুয়া বাঁশখালী হয়ে চট্টগ্রামে ইয়াবা পাচার করে। আবার পথিমধ্যে কিছু চালানসহ ইয়াবা কারবারি আটক হয়ে যায় বাশঁখালী ও আনোয়ারা পুলিশের জালে। পরে মাদক আইনে মামলা করে জেলে দিলেও কয়েকদিন পর আইনের ফাঁক-ফোকরে বের হয়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

অনুসন্ধানে দৈনিক অধিকার জানতে পারে- ইয়াবার এসব হাটগুলো বসে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের বাইম্যাখালী, নন্দীরপাড়া স্টেশন, সৈকতপাড়া, বলিরপাড়া আবাসন, ছড়ারপাড়া, সাবেকগুলদি ব্রিজ, চৈরভাংগা স্টেশনের দক্ষিণে, বিলাহাচুরা, মুইয়াদিয়া, মামা-ভাগিনার দোকান, গোয়াখালী চলতা মার্কেট, মগকাটা, চৌমুহনী মাতবরপাড়ার টেক, পেকুয়া সিকদার পাড়ার ক্রীড়া কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পাশে ও সরকারি হাসপাতালের পূর্ব পাশের এলাকায়। এ ছাড়া উপজেলা গেইট, টইটং ইউনিয়নের ধনিয়াকাটা, বটতলা বাজার, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পাড়া, ধালারমুখ, বনকানন বাজার, মধুখালি বাজার, পন্ডিত পাড়া, টইটং বাজারের পূর্ব পাশের এলাকা, বটতলী জুমপাড়া ও নাপিত খালী পশ্চিম পাড়া এলাকায় ইয়াবার এসব হাট বসে।

একইভাবে রাজাখালী ইউনিয়নের মজুল্লারে নাশি, আরবশাহ বাজারের ডাকায়ত্তা ঘোনা, সবুজ বাজার, বকশিয়াঘোনা, ভাংগাখালী ব্রিজেও মাদকের সিন্ডিকেট রয়েছে। পাশাপাশি মগনামা ইউনিয়নের লঞ্চঘাট, কাকপাড়া, জালিয়াপাড়া, কালারও পাড়াতেও রমরমা মাদকের কারবার চলে। এগুলো ছাড়াও উজানটিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম উজানটিয়া ঘাট, হুয়াক্কা মার্কেট, টেকপাড়া, বারবাকিয়া ইউনিয়নের বুধামাঝির ঘোনা, ভারুয়াখালী, বারাইয়াকাটা, নোয়াখালী ব্রিজ, বারবাকিয়া বাজার, পাহাড়িয়াখালী, শীলখালী ইউনিয়নের কসাইপাড়া, কাচারীমুরা, সাকুরপাড়, জারুলবুনিয়া স্টেশনেও অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে মাদক কারবারিরা।

সচেতন মহলের দাবি, এভাবে পেকুয়ায় ইয়াবা ছড়াছড়ি হলে যুব সমাজ ও ছাত্রসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর হস্তে ইয়াবার এসব হাট বন্ধে ভূমিকা রাখতে হবে।

তাদের অভিযোগ- এসব ইয়াবা চালানের সাথে তথাকথিত বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও জড়িত। তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন জানলেও মুখ খোলেন না কেউই।

এ দিকে, অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলার শীর্ষ নেতাদের সাথে আঁতাত করে এসব ইয়াবা চালান পাচার ও হাট বসাতে মাসিক মাসোয়ারাও দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পুরো উপজেলাজুড়ে বিস্তারলাভ করছে মরণনেশা ইয়াবা। এতে করে অনেকেরই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে।

তারা আরও অভিযোগ করেন, পেকুয়া উপজেলায় কমিউনিটি পুলিশের কমিটি থাকলেও নেই কোনো তৎপরতা। আছে নামেমাত্র কমিটি। খাতা-কলমে থাকলেও নেই কোনো কার্যকারিতায়। উপজেলাজুড়ে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তারা। কাজেই ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে উপজেলা প্রশাসন, থানা প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের সহযোগিতা একান্তই কাম্য জানিয়ে তারা বলেন, পেকুয়াকে ইয়াবার ছোবল থেকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইয়াবা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন : করোনাকালে কুমারখালীর ৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৫ জনের বাল্যবিয়ে!

অন্যদিকে, অভিভাবকরা বলছেন- ভয়ঙ্কর এই মাদক নিয়ন্ত্রণ না করলে ইয়াবার ছোবলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে না পারলেই চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে তারা।

এ বিষয়ে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সাংবাদিক হাজী জালাল বলেন, ইয়াবা টেকনাফের মতো এখন পেকুয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গেছে। তাতে দিনদিন ধ্বংসের পথে পতিত হচ্ছে যুবসমাজ ও ছাত্র সমাজ। এমনকি মহামারি করোনা ভাইরাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র সমাজ আরও পুরোদমে ইয়াবা আসক্ততায় জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়মুখী করা কঠিন হয়েছে। প্রতিনিয়ত উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ইয়াবা নিয়ে বারবার পুলিশ প্রশাসনকে নজরে আনলেও কোনো কার্যকারী ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে পেকুয়া থানার ওসি (তদন্ত) কানন সরকারের সাথে কথা হলে তিনি দৈনিক অধিকারকে জানান, ইয়াবা নিয়ে পুলিশ তৎপর আছে। ইয়াবা কারবারিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেখানে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে পুরোদমে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ওডি/নিলয়

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড