• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নতুন আবিষ্কারে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন শার্শার মিজান

  জাহিরুল ইসলাম মিলন, শার্শা, যশোর

০১ এপ্রিল ২০১৯, ১৬:৩৫
মেকানিক মিজান
মেকানিক মিজান (ছবি : দৈনিক অধিকার)

সমগ্র দেশে আবিষ্কারের প্রতিভা প্রমাণ করে চলেছেন যশোরের শার্শা উপজেলার বিস্ময় মোটরসাইকেল মেকানিক মিজান। তিনি এখন দেশ সেরা গবেষণা উদ্ভাবক। মিজানের অ্যাকাডেমিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও আজ তিনি নিজের আলোয় আলোকিত। নতুন গবেষণায় তার উদ্ভাবনের সংখ্যা ১১টি। তার গবেষণা উদ্ভাবন নিয়ে দেশ, জাতি এখন গর্বিত।

অপ্রয়োজনীয় ফেলনা কিংবা খেলনা নয়, এমন জিনিসের পুনঃ ব্যবহারের চিন্তা থেকে এবার মিজান উদ্ভাবন করলেন পোড়া মোবিল থেকে গ্যাস ও জ্বালানি তেল। মোটরসাইকেল কিংবা কল কারখানায় বাদ পড়া অপ্রয়োজনীয় পোড়া মোবিল পরিবেশ দূষণ করে থাকে। পরিবেশ দূষণ মুক্ত করতে মিজান এ উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সফলও হয়েছেন তিনি। এক বছর ধরে মোবিল নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে জানান মিজান।

মিজান বলেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম আমাদের দেশে লাখ লাখ কলকারখানা, যানবাহন এবং মোটরসাইকেল গ্যারেজ রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পরিত্যক্ত মোবিল। যে মোবিল নষ্ট করছে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে মানবদেহের। এমন চিন্তা ভাবনায় আমি গবেষণা করি এসব মোবিল কিভাবে কাজে লাগানো যায়।

একদিন কিছু বাদপড়া পোড়া মোবিল আমি খোলা মাঠে ঘাসের উপর ফেলে আসি। কিছু দিন পর দেখি ঘাসগুলো মারা গেছে। এমনি ভাবে পানিতে ফেললেও মারা যাচ্ছে মাছ। পোড়া মোবিল কাজে লাগাতে গিয়ে দেখি তা থেকে উৎপাদন হচ্ছে গ্যাস ও জ্বালানি তেল। একটি কন্টিনারে পোড়া মোবিল জ্বালিয়ে গ্যাস তৈরি করেছি। যে গ্যাস দিয়ে রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। আর অবশিষ্ট অংশ রিসাইক্লিং করে ডিজেল মোবিল ও কেরোসিন তেল তৈরি করা যায়। এখন শুধু দরকার সরকারের সহায়তার।’

শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের আমতলা গাতিপাড়ার অজো পাড়া গাঁয়ে ১৯৭১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন মিজান। তার ভাল নাম মিজানুর রহমান। বাবা আক্কাজ আলী এবং মা খোদেজা খাতুন। আজ আর তারা কেউ বেঁচে নেই। বাবা-মার ছয় সন্তানের মধ্যে মিজান পঞ্চম।

বর্তমানে শার্শা উপজেলা সদরের শ্যামলাগাছি গ্রামে তার বসবাস। দরিদ্রতার কারণে লেখাপড়া শিখতে পারেননি মিজান। ৮-৯ বছর বয়সেই বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়েন কর্মে। মাঠে ইরি ধানের ক্ষেতে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন মিজান। পরবর্তীতে নাভারন বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ করেন তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক পেশা হিসেবে কর্ম জীবন শুরু।

বর্তমানে শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ রয়েছে তার। এখানেই তার কর্ম। তবে ছোট বেলা থেকেই তার সখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। তবে মেকানিক হিসেবে ইঞ্জিন তৈরি করতে প্রবল আগ্রহ ছিল। বারবার চেষ্টা করে মিজান তৈরি করেন ইঞ্জিন।

মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করেন হাফ ক্র্যানসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। তার ইঞ্জিনের সমস্ত যন্ত্রপাতি দেখা যেত বাহির থেকে। এ ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানী তেল দিয়ে চালু করলে পরবর্তীতে আর তেল লাগতো না। সৃষ্ট ধোয়া থেকে জ্বালানী তৈরি করে নিজে নিজে চলতো ইঞ্জিনটি।

ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির পর মিজান উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। বাসাবাড়ি, কলকারখানা, অফিস, আদালতে আগুন লাগলে যন্ত্রটি আগুন নেভাতে ৫-১০ সেকেন্ডের মধ্যে নিজে নিজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। বিদ্যুৎ না থাকলেও এটি চলে। এ যন্ত্রটি স্বল্প জায়গায় রাখা যায়। যখনই কোনো জায়গায় আগুন লাগে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও রেড লাইট অন করে দেয়। তার পর একই সঙ্গে সংযুক্ত মোবাইল হতে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফোন দেয় এবং পাশাপাশি যন্ত্রটি পানির পাম্পের সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫-৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব হয়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোর জেলা স্কুলের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় মিজান এটি প্রদর্শন করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।

দেশে পেট্রোল বোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সেই সময় মিজান উদ্ভাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নি নিরোধ জ্যাকেট। এ জ্যাকেট গায়ে ব্যবহার করে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। আগুনের মধ্যে গিয়ে জানমাল রক্ষার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না। চতুর্থ উদ্ভাবন ছিল অগ্নি নিরোধ হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনায় আগুনে গলার শ্বাসনালী পুড়বে না। তার পঞ্চম উদ্ভাবনায় ছিল প্রতিবন্ধীদের জীবন মান উন্নয়নে মোটরকার উদ্ভাবন। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রোল চালিত।

কৃষকদের স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র উদ্ভাবন ছিল তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। কৃষকরা দূর-দূরান্তের মাঠে জমিতে পানি দিতে আর ক্ষেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচ যন্ত্রটি মুঠোফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজে নিজেই চালু হয় এবং পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি একা একাই বন্ধ হয়ে যায়।

দেশীয় প্রযুক্তিতে মিজান তার সপ্তম উদ্ভাবন করেন ফ্যামিলি মোটর যান। ব্যবহার যোগ্য এ যানটি এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মিজানের অষ্টম উদ্ভাবন এ রয়েছে পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। বাসাবাড়ি, অফিস বা কলকারখানায় এটি ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়। এ যন্ত্রটি উদ্ভাবনের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন মিজান পরিবেশ পদক লাভ করেন। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত ৩৮টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য ক্রেস্ট ও পুরস্কার।

ইতোমধ্যে মিজানের উদ্ভাবনায় আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু আই প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে ছোট ছোট এ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালে পরিবেশ বান্ধব যন্ত্র আবিষ্কারে বিশ্ব পরিবেশ পদক নির্ধারিত হওয়ায় ৫ জুন-২০১৭ মিজানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পদক দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর।

মিজান জানান, তার স্বপ্ন দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা এবং আরও নতুন নতুন উদ্ভাবন সৃষ্টি করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করলেন বাদপড়া পোড়া মোবিল থেকে গ্যাস ও জ্বালানি তেল।

ওডি/এএসএল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড