• বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রতিবন্ধীদের আশার আলো দেখাচ্ছে যে স্কুল

  গোলাম মোস্তফা মুন্না, যশোর

১১ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০৩
যশোর
শরীরচর্চা করছে শিক্ষার্থীরা (ছবি : দৈনিক অধিকার)

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সৃষ্টিশীল ও কর্মক্ষম করতে যশোরের ঝিকরগাছায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বাবর আলী সরদার বিশেষ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়।

অন্য দশটি শিশুর মতোই আদর-যত্নে বেড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিশুরা। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানটিতে ৪০০-এর বেশি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু লেখাপড়ার পাশাপাশি পুনর্বাসনের সুযোগ পেয়েছে।

মাত্র পাঁচ মাস আগেও ঝিকরগাছার রঘুরামপুরের বাবর আলী সরদার বিশেষ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক এই বিদ্যালয়ের ছোট্ট টিনের চালার ঘর ছিল। অথচ এখন সেখানে আধুনিক একাডেমিক ভবনসহ গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা।

২০১৪ সালে এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক মরহুম বাবর আলী সরদারের নামে তার সন্তানেরা এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠার শুরুতে মাত্র ১০ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু নিয়ে শুরু করলেও এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪০০। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠানটি শত শত প্রতিবন্ধী শিশুদের চোখে এখন আশার আলোর ফুটে উঠেছে।

স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও বাবর আলীর ছেলে আব্দুল আলিম বলেন, জেলার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা ও আশপাশ এলাকায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা অনেকটা অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে। সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। এসব দিক বিবেচনা করে বাবার আত্মার মাগফিরাতের অংশ হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলি।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালে আমার স্ত্রীর নামে ৩৩ শতক জমি স্কুলের নামে দান করে দেই। এরপর ছোট্ট একটা চালা ঘরে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করি। স্কুলটিকে দাঁড় করাতে গিয়ে নিজের অর্থ শ্রম ব্যয় করে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিবন্ধী শিশুদের সংগ্রহ করে স্কুলে ভর্তি করানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। এসব শিশুদের যাতায়াত, টিফিন, বই-খাতাসহ যাবতীয় সুবিধা দিতে থাকি। এক পর্যায়ে অল্প দিনের মধ্যে এলাকার লোকজনের মধ্যে স্কুলটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।

আব্দুল আলীম বলেন, স্কুলটিতে বর্তমান একতলা দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন করা হয়েছে। নয়টি কক্ষ বিশিষ্ট একাডেমিক ভবনে শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে। এসব অধিকারবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক পরিচর্যা দিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন ১৮ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি, শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলায় পারদর্শী করে তুলছেন তারা।

তিনি আরও বলেন, স্কুলটিকে এই পর্যায়ে আনতে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া মেলেনি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে ও এলাকার মানুষের সহযোগিতায় আজ এ পর্যায়ে এসেছে। তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, দেশে কত অখ্যাত স্কুল প্রতিষ্ঠান এমপিও করা হচ্ছে। অথচ আমাদের এ প্রতিষ্ঠানের মতো এ প্রতিষ্ঠান আজও এমপিও তালিকায় উঠছে না।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক তৌহিদুজ্জামান বলেন, গ্রামের অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যান্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মতো সুবিধাবঞ্চিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে সরকারি ভাবে আমাদের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে আমরা যারা শিক্ষকতা করি তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিবন্ধী রয়েছেন। তারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও বিনা বেতনে এখানে সেবা দিচ্ছেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য যাতায়াতের জন্য আলাদা পরিবহন রয়েছে। শিশুদেরকে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় পারদর্শী করে তোলা হচ্ছে। ২০১৯ সালে আবুধাবিতে বিশেষ অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করে এই স্কুলের দুই শিক্ষার্থী পদক পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা সাহিদা খাতুন। জন্ম থেকে তার দুই পা নেই। যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। তিনি বর্তমানে ওই স্কুলের প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছেন।

শিক্ষিকা সাহিদা খাতুন বলেন, আমি নিজেই একজন সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। এজন্য আমি এ স্কুলে চাকরির সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। নিজে প্রতিবন্ধী হয়ে অন্য প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকতে পারছি এর চেয়ে আমার ভালো আর কী হতে পারে।

তিনি বলেন, সরকার একটু আন্তরিক হলে আমাদের মতো প্রতিবন্ধীরা সমাজে অন্য দশটি মানুষের মতো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি। তাই সরকারের কাছে দাবি দ্রুত যেন এ স্কুলটি জাতীয়করণের ব্যবস্থা করে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় খুশি অভিভাবক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা।

সাবিনা ইয়াসমিন নামে একজন বিশেষ সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মা বলেন, আমার সন্তান আগে বাড়িতে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকত। এ স্কুলটি হওয়াতে অনেক সুবিধা হয়েছে। অন্যসব শিশুদের সাথে সে স্কুলে আসছে, ছবি আঁকছে, খেলাধুলা করছে। এখন সে অনেক স্বাভাবিক। এসব শিশুদের মানসিকভাবে গড়ে তুলতে এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন: সড়কে প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যসহ ২ জনের

সম্প্রতি স্কুলটিতে পরিদর্শন করেন ঝিকরগাছা উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা স্কুলটির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

ঝিকরগাছা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. অহিদুজ্জামান জানান, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন স্কুল গড়ে তোলা খুবই কঠিন ব্যাপার। আমরা সরেজমিনে স্কুলে গিয়ে যে অবস্থা দেখেছি তাতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। স্কুলটি দ্রুত যেন এমপিওভুক্ত হয় সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রতিবেদন পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

ওডি/এমবি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড