ফরিদ ছিফাতুল্লাহ্
দিন কয়েক আগে লালমনিরহাট থেকে অটোরিকশাযোগে রংপুর আসার পথে হেমন্ত দৃশ্যমান হল পথের দু-ধারে। যতদূর চোখ যায় বিরান মাঠ, খাদ্যের সন্ধানে সেই শূন্য মাঠজুড়ে পাখিদের ওড়াউড়ি। মাঠগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল বিষণ্ণ সন্তানহারা -শোকে মুহ্যমান। তার বুকে উৎপাদিত সন্তানসম ফসলের কাটা অংশ পড়ে আছে মাঠ জুড়ে। আর মাঠগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বিষণ্ণ বদনে।
এক সময় নাকি হেমন্তেই শুরু হতো বাংলাবর্ষ। কেননা এই ঋতুতেই বাঙালির ঘরে উঠত নতুন ধান। আর নতুন ধান মানেই নতুন আনন্দ। অনেকেরই এই ধানের ওপর পরবর্তী কয়েক মাস নির্ভর করতে হতো। তাই জমিদারের খাজনা, পেট পুরে খাওয়া আর মন ভরে আনন্দ করার উপলক্ষ এনে দিত এই হেমন্ত। হেমন্ত তাই আবহমান কাল ধরেই এ দেশের ঋতু বৈচিত্র্যের এক অনন্য সময় কাল। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের মতো প্রধানভাবে অনুভূত না হলেও হেমন্ত স্বল্পস্থায়ী কিন্তু বিশেষ গুরুত্বের এক ঋতু।
জনজীবনে এর প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। জনমানসেও এক মধুর পরশ বুলিয়ে যায় হেমন্ত। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে হেমস্তের প্রভাবে। হেমন্ত প্রভাবিত করেনি এমন কবি বা লেখক খুব কমই পাওয়া যাবে। কেউ যদি হেমন্ত নিয়ে সরাসরি নাও লিখে থাকেন তবুও তাঁর লেখার কোথাও না কোথাও হেমন্তের ছাপ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে না বোধ হয়। ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’- রবীন্দ্রনাথ সেই মধ্যযুগের পদকর্তাদের থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ আর তার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ, সুফিয়া কামাল, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দিন প্রত্যেকেই কলম থেকেই দুয়েক ছত্র হেমন্ত রচিত হয়েছে।
আজকের কবিরাও হেমন্ত দ্বারা নিয়মিতই প্রভাবিত হয়ে চলেছেন। শরতের সবুজ মাঠ সোনালি রং পেয়ে যায় হেমন্তে। শরতের শ্বেত-শুভ্র মেঘ ও নীল আকাশ বিদায় নিতে নিতে হেমন্তের হিম হিম অনুভূতি এক পা দু-পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। শোনায় শীতের আগমনী গান। অনেকটা রাজদরবারে রাজার প্রবেশের প্রাক্কালে যেমন ঘোষক ঘোষণা করে রাজার আগমনবার্তা।
হেমন্ত শুধু আনন্দই বয়ে আনে না। সাথে করে নিয়ে আসে বিষাদও। ফসলের মাঠগুলো কী রকম বিরান, রিক্ত আর শূন্য হয়ে পড়ে। তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। তবু হেমন্তের আগমন শীতের পূর্বাভাষ বলে কিছুটা স্বস্তি। বর্ষার অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে একঘেয়েমি চলে এলে মন তখন একটা পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। শরৎ সেই পরিবর্তনের সূচনা করে। শরৎ চমৎকার একটি ঋতু। কিন্তু খুব ক্ষণস্থায়ী। শহরের অনেকে শরতের আগমন বা প্রস্থান টেরও পান না।
উত্তরবঙ্গের এই নির্জন রাস্তায় অটোরিকশার হালকা দুলুনিতে দুলছি আর দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মাথামুণ্ডুহীন নানান কথা ভাবছি।
জীবন কত সুন্দর! এই পার্থিব জীবন কত অপার্থিব আনন্দে ভরা! জীবন কত বাঁক বদল করে! শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, বার্ধক্য; ছাত্রজীবন, কর্মজীবন; বিবাহিত, অবিবাহিত; সাফল্যের দিন, ব্যর্থতার দিন; প্রেমের সময়, অপ্রেমের সময়; বিষাদের, আনন্দের; হারানোর, পাওয়ার; একাকিত্বের, মুখরতার; কত শত এমন বাঁক। আমি তো দেখি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অনন্য। একটা থেকে আরেকটা পুরোপুরি আলাদা। আলাদা হয়েও একটি আরেকটির সাথে গাঁথা। যেন এক মুহূর্তমালা। এই বিষাদে আবার এই আনন্দে বিরাজে মন।
যে মানুষ তার গৃহকর্মীর গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়, সেই মানুষকে কি কেউ কখনো ভালোবাসেনি, কোন কারণে? সে কি কাউকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কোনোদিন চুমু খায়নি? সে গান শোনেনি কোনোদিন? সে কি সবুজ দেখে চোখ জুড়ায়নি? তার কি সাগর বা পাহাড় কিছুই ভালো লাগেনি কোনোদিন? এর নেতিবাচক উত্তর আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ইচ্ছাও করে না এটা বিশ্বাস করতে। কোনো মানুষই শতভাগ ভালো নয় বা শতভাগ মন্দ নয়। সবাই কখনো খারাপ, কখনো ভালো। আমরা ভালো-মন্দ দুই রকম চিন্তাই করি, দুই রকম কাজও করি। কেউ কেউ এই গড়পড়তা ভালো মন্দ ছাড়িয়ে আলাদাভাবে ভালো বা মন্দ তকমা প্রাপ্ত হয়ে যায়। কেউ সুনাম কুড়ায়, কেউ দুর্নাম। কেউ সমাজের মুখ উজ্জ্বল করে, কেউ কালি লেপে দেয়। কেউ অপরাধী হয়, কেউ পরোপকার করে। এভাবেই চলছে জীবন। চলবেও।
অনেকের অপরাধের পিছনে অনুঘটক হিসেবে কোনো কারণ থাকে। কেউ কেউ বিনা কারণেই শুধু রুচির বিকৃতির ফলে অপরাধী হয়ে ওঠে। এই বিকৃতির মূলেও অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণ থাকতে পারে। সব বিবেচনা করেই হয়তো কথাটার প্রচলন ঘটেছিল- ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’।
আধুনিক বিচারের রীতি নীতি গড়ে উঠেছে যে সব মূল ধারণার ওপর সেগুলোর একটি হলো অপরাধীর সংশোধনের ব্যবস্থা করা । আরেকটি হলো অপরাধী কর্তৃক অপরাধের দূষণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকলে অপরাধীকে সমাজের আর সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আর কিছু অপরাধের জন্য একেবারে দুনিয়া থেকে বিদায়ের ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। যদিও আজকের সভ্যতার নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর অধিকাংশ দেশেই এই দণ্ড বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা অমানবিক এবং এটা থাকা উচিতও নয়।
মানুষের বিচারের প্রক্রিয়ায় ত্রুটিজনিত কারণে একজন নির্দোষ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড পেয়ে গেলে এবং তা কার্যকর করার পর সেই ত্রুটি উদঘাটিত হলে সেই নির্দোষ ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ বা বিচারের ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ আর থাকে না। আর তাছাড়া যে মানুষ বা মানুষের যে সংগঠন জীবন সৃষ্টি করতে পারে না তার জীবন হরণের কোনো অধিকার থাকাও উচিত নয়। একবার জন্মাবার পর বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেকের আছে। অপরাধীরও আছে। কোনো মানুষই নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আগমন করে না। অথবা কোনো মানুষই জন্মাবার আগে সে তার জন্মস্থানে প্রতিষ্ঠিত সমাজ বা রাষ্ট্রের সব নীতি-নৈতিকতা বা আইন কানুন মেনে চলবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আসে না। যে আইন মেনে চলবার জন্য সে কোনো চুক্তি, প্রতিশ্রুতিই দেয়নি সমাজ সেই আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে তাকে শাস্তি দিচ্ছে এক রকমের জবরদস্তি করে। আর যদি মৃত্যু দণ্ড দিয়ে তাকে বিদায় করা হয় সেটা তো আরও জবরদস্তি।
এই যে রাষ্ট্রের সীমানায় আমার বসবাস। এই যে রাষ্ট্রের সমাজের সব আইন মেনে চলতে আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে - আমি যদি তা মানতে অস্বীকার করি? আমি যদি বলি রাষ্ট্র নয় আমার ব্যাপারে আমিই সার্বভৌম। এই রাষ্ট্র আমি মানি না। রাষ্ট্র তখন আমার হাতে পায়ে বেড়ি পরাবে। আমি দুর্বল, রাষ্ট্র সবল বলে এই ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা দুর্বলের ওপর সবলের জুলুমের ব্যবস্থা। রাষ্ট্র না হয় আমাকে অপশন দিল - আর দশজন যে আইন মেনে চলে সে আইন মানতে না চাইলে তুমি এই সমাজ, রাষ্ট্র ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করো। (যদিও আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। এক জবরদস্তি ছাড়া। কেননা বাবা তো আমার মালিক নয়, মাও নয় ,সমাজ নয়, রাষ্ট্র নয়। আমি সময়ের সন্তান- এটা আমার কথা নয়। প্যালেস্টাইনের কবি দার্শনিক কাহলিল জীবরানের কথা।) তো আমি কোথায় গমন করব? রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সীমানা বানিয়ে রেখেছো তোমরা। সেই সীমানা অতিক্রম করতে তো তোমরাই বাধা দেবে। বনে যাব, পাহাড়ে, নির্জন দ্বীপে? সব গহীন দুর্গম বন জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সমুদ্র তো তোমরা রাষ্ট্ররা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছো।
এই রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নেবার জন্য আমার মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করেছো তোমরা। ধর্ম, স্কুল ইত্যাদি বানিয়ে তোমাদের বানানো নীতি-নৈতিকতা আমাকে গেলাচ্ছো। আর শুধু শুধু হীরক রাজাকে তার যন্তর মন্তর ঘরের জন্য দোষারোপ করো। ব্যঙ্গ করো।
নর-নারীর যৌনতা, পেটের ক্ষুধা, চিত্তের খোরাক, সম্মানিত হবার বাসনা, অন্যকে অধীনস্ত করার প্রবণতা আমার জৈবিক। এগুলোর ক্ষেত্রে আমি প্রকৃতিগত এবং প্রাকৃতিক ভাবে স্বাধীন। এই স্বাধীনতা হরণ করে তোমাদের সমাজে তোমাদের রাষ্ট্রে বসবাসের উপযোগী করে তুলেছ আমাকে। আমার সম্মতি অসম্মতি জ্ঞাপনের সুযোগ না রেখেই।
প্রেমময় দৃষ্টি দিয়ে দেখলে এই জগতের সব কিছুই ভালো। কোন কালো নাই কোথাও। কোথাও কোনো অন্ধকার নাই। কোথাও কোনো মন্দ নাই। যা কিছু মন্দ তার দায় আমার। যা কিছু ভালো তার সব তোমার- এরকম প্রেমপূর্ণ ভাবনার, দৃষ্টির আজ খুব প্রয়োজন। এত দলাদলি, হিংসা হানাহানি, সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা ভোগের অসীম লিপ্সা না পারছে আপনাকে নির্বিঘ্ন নিষ্কলুষ স্বর্গীয় সুখ দিতে না পারছে আমাকে নিরাপদ রাখতে। ক্ষণকালের মানব জনম সাঙ্গ করি আমরা তো সবাই যাব দুনিয়া ছাড়ি। তবে কেন এই সব পাপ, কালো, অন্ধকার স্থান পায় সমাজে। এর সবই ভ্রান্তিজনিত।
আমরা একে অপরকে আঘাত করবার সময় নিজে সেই আঘাতের যন্ত্রণা বুঝি না। বুঝতে চাইও না। সময়কালে সেও তাই আমারটা বোঝে না। আমরা একজন আরেকজনকে বঞ্চিত করার সময় বঞ্চনার বেদনা অনুভব করি না। তাই আমরা নিজেরা বঞ্চিত হই, অপরকেও বঞ্চিত করি। এ এক ভুলের ঘোর। এই ঘোরে আচ্ছন্ন আমাদের সংস্কৃতি, শিক্ষা, মূল্যবোধ, ধর্ম, আমাদের ন্যায়-অন্যায় এমনকি ভালো-মন্দ বোধ। তাই সমাজে শুভশক্তির উন্মেষ প্রয়োজন। প্রয়োজন শুভবুদ্ধির জাগরণ।
মনে রাখা দরকার ব্যক্তির মতো সংগঠন এমনকি একটি পুরো জনগোষ্ঠীও স্বৈরাচারে পরিণত হতে পারে, ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে। কেননা ব্যক্তি ছাড়া সংগঠনের আলাদা কোনো সজীব সচেতন সত্তা নেই। নেই কোন পৃথক চলাফেরা বা মতামত। একটা সমাজও একটা সংগঠন।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যে যুগে কিছু দৈত্য দানবের উৎপত্তি ঘটেছে। কিছু যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে যেগুলো দিয়ে একটা সমাজকে, সমাজের সম্মিলিত মানুষকে একইসাথে ডানে, বামে চালানো যায়। এর প্রভাবে সমস্বরে একটা সমাজ এক কণ্ঠে এক জনের ফাঁসির দাবি তোলে। একজনের বিচারের রায় বিচার বিবেচনা ছাড়াই দিয়ে দেয়। এটা না মেনে উপায়ও নাই। এই মেশিনগুলোর অনেক নাম আছে। যেমন- গণমাধ্যম, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন : নবান্ন মানে নতুন অন্ন
এই সব যন্ত্রের যাঁতাকলে ‘মানুষ’ নামের সজীব সত্তা পিষ্ট হয়েই চলেছে। চলতেই থাকবে। জীবন কেন এমন?
হেম শব্দের আরেক অর্থ সোনা। এই সোনাঝরা হেমন্তের দিনে তাই আমরা সোনালি এক চিন্তায় নিবিষ্ট হতেই পারি- পৃথিবী প্রেমময় হোক । পারমাণবিক বোমা বা প্রবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে নয় সর্বপ্রাণে প্রেম ছড়িয়ে পৃথিবী বিজিত হোক।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড