• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার নবান্ন সংখ্যা-১৯

নবান্ন মানে নতুন অন্ন

  শব্দনীল

২৮ জানুয়ারি ২০২০, ১৬:০৯
নবান্ন
শরতের পরেই আসে হেমন্ত (ছবি : সম্পাদিত)

ঋতুবৈচিত্র্যের এই পালল ভূমিতে বারো মাসে তেরো পার্বন অনুষ্ঠিত হয়। লাঙলের ফলার মাঝে লুকিয়ে রাখা নিজস্ব আভিজাত্যকে একেক ঋতু খুলে বসে প্রকৃতির সর্বাঙ্গে। শুধু মাত্র প্রকৃতিতে নয় জনজীবনেও এই আভিজাত্যের প্রভাব বিদ্যমান। আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতিও সমৃদ্ধতার শুরু যেমন কৃষি থেকে তেমনি মাটির সোঁদাগন্ধ মিশে থাকে আমাদের প্রতিটি উৎসবে। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর এই ধরায় ষড়ঋতুর দেশে দু’মাস অন্তর অন্তর ঋতু বদল ঘটে। গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে, শরতের পরেই আসে হেমন্ত।

হেমন্তকে বলা হয় অনুভবের ঋতু। ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্ট। তাকে যেভাবে অনুভব করা যায়, ঠিক সেভাবে ছোঁয়া বা দেখা যায় না। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত তীব্র, প্রখর অথবা উন্মোচিত নয়। বসন্তের মতো নেই তার বর্ণ, গন্ধ, গরিমা। হেমন্ত মৌন, শীতল, বলা যায় অন্তর্মুখী। আমাদের দেশে হেমন্ত আসে ধীর পায়ে, শিশির স্নাত শীতল পরশ আলতো গায়ে মেখেমেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই কৃষিপ্রধান এ দেশে সূচনা হয় নবান্ন উৎসব। ইংরেজিতে যাকে বলে, নিউ রাইস ফেস্টিবল।

নবান্ন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ মানে ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন শুরু হয় আমন ধান কাটার পর, এই ধানের চালের প্রথম রান্না উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। সাধারণত অগ্রহায়ণে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু। কোথাও কোথাও মাঘেও নবান্ন উদযাপনের প্রথা রয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখে, বাকি অংশ চাল করা হয়। এই চালের পায়েসে এই উৎসব হয়।

নবান্ন উৎসব হিন্দুদের প্রাচীন প্রথা। এই অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক নানা প্রাণীকে উৎসর্গ করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশনের পর গৃহকর্তা ও পরিবারের সদস্যরা নতুন গুড় দিয়ে নতুন খাদ্য গ্রহণ করেন। কলার ডগায় নতুন চাল, কলা, নতুন চালের নারকেল নাড়ু, বিভিন্ন খাদ্য কাককে নিবেদন করা নবান্নের বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছায়। এই নিয়ে ছড়াও রয়েছে। বাচ্চারা ছড়া কেটে দাঁড় কাককে আমন্ত্রণ করে- ‘কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন। শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা, পাতি কাউয়া লাঠি খায়, দাঁড় কাউয়া কলা খায়, কো কো কো, মোর গো বাড়ি শুভ নবান্ন।’

কাকবলির আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ, বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা বরিশালে প্রচলিত। বাড়ির উঠানের মাঝে একটি গর্ত করে তার চারপাশে পিটুলি দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কৈ মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাঁধে উৎসব করে। একে বীরবাশ বলে।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে নবান্ন উৎসব হয় বৈশাখে। সেখানে রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এই উৎসব হয়। এমন নবান্ন উৎসব দক্ষিণ ভারতেও প্রচলিত। বাংলাদেশের কয়েকটি উপজাতিও তাদের ধান ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে সাত দিন সাত রাত গানবাজনা ও মদ্যপানের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে। উসুই উপজাতি অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে খাওয়ায়। গারো উপজাতি ফসল তোলার পর ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পানাহার, নাচ-গানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে।

হেমন্তে ফসলের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে প্রকৃতি। নবান্নের আয়েশি বন্দরে নোঙর খাটিয়ে কৃষক এই মৌসুমে ধান কাটে উল্লাসে। পিছিয়ে থাকে না কৃষাণীরাও, তারা ধানকাটার তালেতালে গায়- ‘কচ্-কচা-কচ্ কচ্-কচা-কচ্ ধান কাটি রে (ও ভাই) ঝিঙ্গা শাইলের হুডুম ভালা বাঁশ ফুলেরি ভাত্ লাহি ধানের খই রে দইয়ে তেলেস্মাত্। ... কস্তর গন্ধীর চাউলের আলো সেই চাউলেরই পিঠা ভালো সেই পিঠায় সাজিয়ে থালা দাও কুটুমের হাতে রে। .............ঐ’ নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা পিঠা পায়েস, ক্ষীরসহ নানা সুস্বাদু খাবারে গন্ধে মাতাল হয় চারপাশ। সোনালি ধানের প্রাচুর্যতায় নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিক সৃষ্টি করেন গল্প, কবিতা, গান। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’।

কবিতার লাইনের মতো নবান্নের চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ রূপ। শুধু কি জীবনানন্দ একা মুগ্ধ হয়েছেন তা নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখেছেন হেমন্তের চরাচরে শান্তি। তিনি লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

কবি জসীম উদ্দীনের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ফসলের মাঠ থেকে আগামীর সম্ভাবনা। তিনি এঁকেছেন - ‘পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত, সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত। ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করিবাতাসে ঢলিয়া পড়ে, ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখি গুলো শুয়েছে মাঠের পরে। কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী, হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি। কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়, ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।’

‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় নবান্নের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বেশ আনন্দচিত্তের প্রকাশ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- ‘ঋতু খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত? নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ। ‘গিন্নি পাগল’ চালের ফিরনী তশ্তরী বরে নবীনা গিন্নি হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত শিরনি রাঁধেন বড়বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত। মিঞা ও বিবিতে বড় ভাব আজি খামারে ধরে না ধান বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান; শাশবিবি কন্, আহা, আসে নাই কতদিন হলো মেজলা জামাই।’

আরও পড়ুন : কবিতায় ছন্দের দ্বিধাদ্বন্দ্ব

একটা সময় সাড়ম্বরে নবান্ন উদযাপন হতো। মানুষের ভেতরে সমাদৃত ছিল অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবেও। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব অনেকটা রং হারিয়েছে। তবে এখনো বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু স্থানে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপন হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উদযাপন পালন শুরু হয়। প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণে জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ এ উৎসব আয়োজন করে।

ওডি/এসএন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড