• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় (পর্ব- ৪)

রাগ বা অনুরাগ কিছুই হিমালয়কে কোনো লেখা পড়ার সময় আক্রান্ত করত না

  অধিকার ডেস্ক    ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:২৪

উপন্যাস প্রকাশন
ছবি : সম্পাদিত

একজন ব্যতিক্রমী মননের মানুষ মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। ব্যতিক্রমী তার লেখার ধারা। কেউ কেউ মনে করে তিনি বিচিত্র রঙের গল্পকার। কারও কাছে সুচিন্তিত সমালোচক, আবার কারও কাছে সূক্ষ্ম বিশ্লেষক। অনেকের কাছে অবশ্য তিনি বর্তমান সময়ের সেরা ক্রিকেট বোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি তিনি পাঠক মহলে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন ‘নামহীন দামহীন’ শীর্ষক বিশ্ব ব্যতিক্রমী এক আত্মজীবনীর মাধ্যমে। আসলে কেমন মানুষ হিমালয়? কাছের মানুষদের চোখে তার ব্যক্তিত্ব কেমন? ব্যতিক্রমী চিন্তার এই মানুষটিকে নিয়ে লিখেছেন তার সঙ্গে কিংবা আশেপাশে থাকা কিছু নিকটবর্তী মানুষ। তাদের বলা কথাগুলো নিয়েই ‘উপন্যাস প্রকাশন’ এর উদ্যোগে ‘দৈনিক অধিকার’ এর ধারাবাহিক আয়োজন, ‘আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়’

আজ প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক এ আয়জনের ৪র্থ পর্ব। এ পর্বে লেখক হিমালয়কে নিয়ে লিখেছেন- ব্লগার লীনা দিলরুবা

পেছনে তাকালে দেখা যাবে সময়ের একটি দীর্ঘ রেখা, ধূসর আর অস্পষ্ট। সম্পর্কটা বস্তুতপক্ষে আন্তরিক ছিল, ছিল বন্ধুর মতো, ছিল বড়বোন আর ছোট ভাই এর স্নেহমাখা। এত সবকিছুর দাবিতে আমার আর হিমালয়ের মধ্যকার সম্পর্কের মাত্রাটা যেখানে অবস্থান করার কথা ছিল কিংবা আমাদের পরিচয়ের পেছনের পথটার রেখা যতোটা স্পষ্ট হবার কথা ছিল, সেটি থাকে নি; ধূসর আর বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। সম্পর্কের সুতো এভাবে কেটে যাবার কথা ছিল না!

একই ব্লগে লেখালেখি করেছি আমি আর হিমালয়, ব্লগীয় সূত্রে যে দু-চারজন বন্ধু, ছোট ভাই, ছোট বোন, সুহৃদ আমার জীবনে জুটে গিয়েছিল, হিমালয় ছিল তাদের মধ্যে একজন। একটু বাড়িয়ে বললে বলতে হবে, হিমালয় ছিল অন্যরকম প্রিয় একজন মানুষ। তখন হিমালয়ের বয়স কতো! বছর বাইশ-তেইশের যুবক হিমালয়। বুয়েটে পড়তো। ব্লগের বন্ধুবান্ধদের আমরা অনেকেই তখন চাকরি-বাকরি, সংসার করা রীতিমতো বয়স্ক লোক। কিন্তু কি করে যেন ব্লগিং এর সূত্র ধরে হিমালয়ের সঙ্গে আমাদের অনেকের আন্তরিক একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সেটি কেন, কীভাবে, সেই রহস্য উন্মোচন করতে হলে ব্লগে হিমালয়ের ব্লগিয় ভূমিকা, আমাদের অনেকের ব্লগের জীবন নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে। বলতে হবে ব্লগে মূলত আমরা কী করতাম, বলতে হবে ব্লগ আমাদের জীবনকে কী দিয়েছিল।

আগের পর্ব পড়তে : ‘নামহীন দামহীন’ মূলত ওর জীবনের গল্প, জীবনদর্শনের আখ্যান

'সামহোয়্যার ইন' ব্লগের মালিক ছিলেন জানা আপা আর আরিল। এই দম্পতি বাংলা ব্লগের ভুবনে যে অবদান রেখেছিলেন সেটি এখন রীতিমতো ইতিহাস। বাংলা ব্লগের ইতিহাস লিখতে হলে এদের দুজনার কথা প্রথমেই বলে পরে অন্যদের কথা বলতে হবে। তাঁদের হাতে গড়া 'সামহোয়্যার ইন' (আমরা সংক্ষেপে বলতাম সামু) আমার মতো দু'চারকলম লিখতে পারাদের জন্য লেখার একটি জায়গা হয়েছিল। এখানে পেয়েছি দেশসেরা লেখকদেরও। কিন্তু বাইরে যে, যে-পরিচয়েই থাকুক না কেন সামুতে আমাদের সবার একমাত্র পরিচয় ছিল 'ব্লগার'।

ব্লগাররা পরস্পরের লেখা পড়তো, মন্তব্য করত। অনেকে তখন রাতদিন ব্লগে পড়ে থাকতো। সামুতে দেশ-বিদেশের শত শত ব্লগার একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেয়েছিল যেখানে নিজের সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটানো যেতো। ব্লগ থেকে বেরুতো গ্রন্থও। দেখা যেতো, ব্লগে কেউ একটি কবিতা পোস্ট করেছে, কিংবা ভ্রমণকাহিনী, কিংবা গল্প। ব্লগাররা হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেই লেখার ওপর।

হিমেল

বাঁ'য়ে লীনা দিলরুবা, ডানে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়

কারো সুচিন্তিত মতামত, কারো হালকা মতামত, কারো ফান, কারো 'ইট রেখে গেলাম' ধরনের কথাবার্তা পোস্টের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতো। রাতবিরাতে 'আসেন গল্প করি' এ ধরনের পোস্টেও শত শত মন্তব্য আর পাল্টা মন্তব্য চলতো। সেই আমাদের এক দিন ছিল!

হিমালয় বছর বাইশ-তেইশের যুবক, দু'হাতে দুটি চায়ের কাপ নিয়ে দেয়া প্রোফাইল পিকচার দিয়ে তার ব্লগ সাজিয়েছিল। সে ছিল সিরিয়াস ধরনের লেখার ব্লগার। হালকা লেখা-টেখায় তার দেখা না মিললেও সিরিয়াস পোস্টে হিমালয়ের লম্বা মন্তব্য ছিল অবধারিত। একটি লেখা পড়ে তার সমস্ত আঙ্গিক মাথায় নিয়ে হিমালয়ের রাখা সুচিন্তিত সেসব মন্তব্য ছিল ইউনিক।

আসলে হিমালয়ের মতো করে একটি মানুষও মন্তব্য করতে পারতেন না। কারণ হিমালয় কোনো লেখাকেই ছোট করে দেখতো না। রাগ বা অনুরাগ কিছুই তাঁকে কোনো লেখা পড়ার সময় আক্রান্ত করত না। সে বুঝে শুনে উচিত কথাটি বলে হয় লেখককে উৎসাহ যোগাতো, নয়তো লেখকের দুর্বল জায়গা ধরিয়ে দিয়ে ভবিষ্যত লেখাটির জন্য লেখককে প্রস্তুত হতে সাহায্য করত। এতো অল্প বয়সের একজন যুবক কি করে এমন দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করত, এ নিয়ে আমরা সবাই বিস্ময় প্রকাশ করতাম।

হিমালয় নিজে মূলত বুক রিভিউ করত, গল্প লিখত। হিমালয়ের গল্প ছিল সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে, মানুষ নিয়ে, মানুষের বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে। সবমিলিয়ে আমরা হিমালয়কে চিনতাম এভাবে, হিমালয় একজন পড়ুয়া, ভালো লেখক।

ব্লগাররা শুধু অনলাইনের পরাবাস্তব দুনিয়ায় নয়, আস্তে আস্তে দেখা-স্বাক্ষাতের মাধ্যমে যোগাযোগের ভিন্ন একটি ধরনের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। ব্লগারদের মধ্যে এইযে একটি চমৎকার মিথস্ক্রিয়া সেটি ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। এই করতে করতে একদিন ব্লগে দেখি হিমালয় বইমেলায় বই কেনার ইচ্ছেকে মাথায় নিয়ে চাঁদা বা ধার চেয়ে বড় ভাইবোনদের কাছে আবদার করে একটি পোস্ট দিয়েছে। ওর লেখাটি মজার ছিল।

অনেকেই আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছিল কী পদ্ধতিতে তাকে টাকা দেয়া যায়। আমিও আগ্রহী হলাম এবং বুয়েটে গিয়ে বই কেনার টাকা পৌঁছে দিলাম। সেই প্রথম হিমালয়কে দেখি, গল্প করি। হিমালয় লেখায় যেমন সিরিয়াস, পরিচিত হতে গিয়ে দেখলাম সে আচার আচরণেও সিরিয়াস টাইপ। বেশ লেগেছিল এই প্রায় যুবা আবার বালক টাইপ সিরিয়াস মানুষটিকে।

এরপর হিমালয়ের লেখা বই বেরোয়। বই পড়ি, রিভিউও লিখি। হিমালয় একটির পর একটি বই প্রকাশ করেছে। নিজের কাঁধেই পুরোটা ভার নেবো, আমি এরপর হিমালয়ের নিজের বা তার লেখার; কোনো খোঁজই রাখিনি। তারপর, চলে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। বুয়েটে গিয়ে দেখা করার পর আরো দু'চারবার হিমালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে দেখা হলেও হঠাৎ করে তার সঙ্গে যোগাযোগের সেতুটা ভেঙে পড়েছিল। সম্পর্কের সুতোটা আসলে পুরোটাই ছিঁড়ে গিয়েছিল, যেটি আমিও টের পাইনি, হয়তো হিমালয়ও টের পায় নি। অথবা হিমালয় টের পেয়েছে, কিন্তু তার সংবেদনশীলতা এতো উচ্চ মাত্রার যে, হয়তো অভিমান করেই আর যোগাযোগ করে নি।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তো আসলে নদীর মতো। উত্থান-পতনের। বাঁক বদলের। নদীর যেমন রং বদলায়, মানুষের সম্পর্কও রং বদলায়। রং বদলাতে বদলাতে চেনা মানুষও একদিন অচেনা হয়ে যায়। প্রকৃতি মানুষকে এসবে অভ্যস্থ করেছে, তাই একদিন যাকে অনিবার্য মনে হয়, রং বদলে সে-ও পুরোপুরি অচেনা হয়ে যেতে পারে। মানুষকে এসব মেনে নিতে হয়। কারণ, এই মানা-না মানার রহস্যই জীবন!

হিমালয়, আমার ভাইসম মানুষটির সঙ্গে ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগাবার জন্য এই লেখাটি কোনো উপলক্ষ্য তৈরি করবে কি না 'সময়'ই এর উত্তর দেবে। তবে শুভকামনা জানাবার জন্য নিশ্চয়ই সময়ের হেয়ালীপনাকে আমি প্রশ্রয় দেবো না। হিমালয়ের জন্য অনন্ত শুভকামনা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড