• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় (পর্ব- ৩)

‘নামহীন দামহীন’ মূলত ওর জীবনের গল্প, জীবনদর্শনের আখ্যান

  অধিকার ডেস্ক    ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৪৯

উপন্যাস প্রকাশন
ছবি : সম্পাদিত

একজন ব্যতিক্রমী মননের মানুষ মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। ব্যতিক্রমী তার লেখার ধারা। কেউ কেউ মনে করে তিনি বিচিত্র রঙের গল্পকার। কারও কাছে সুচিন্তিত সমালোচক, আবার কারও কাছে সূক্ষ্ম বিশ্লেষক। অনেকের কাছে অবশ্য তিনি বর্তমান সময়ের সেরা ক্রিকেট বোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি তিনি পাঠক মহলে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করেছেন ‘নামহীন দামহীন’ শীর্ষক বিশ্ব ব্যতিক্রমী এক আত্মজীবনীর মাধ্যমে। আসলে কেমন মানুষ হিমালয়? কাছের মানুষদের চোখে তার ব্যক্তিত্ব কেমন? ব্যতিক্রমী চিন্তার এই মানুষটিকে নিয়ে লিখেছেন তার সঙ্গে কিংবা আশেপাশে থাকা কিছু নিকটবর্তী মানুষ। তাদের বলা কথাগুলো নিয়েই ‘উপন্যাস প্রকাশন’ এর উদ্যোগে ‘দৈনিক অধিকার’ এর ধারাবাহিক আয়োজন, ‘আমার চোখে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়’

আজ প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক এ আয়জনের ৩য় পর্ব। এ পর্বে লেখক হিমালয়কে নিয়ে লিখেছেন- শিক্ষা গবেষক ‘চমক হাসান’

বুয়েটে একবার ক্যাফেটেরিয়ার সামনে একটা দেয়ালিকা বসানো হবে। আমারও একটা লেখা থাকবে সেখানে। সেটার উদ্বোধনের দিন আয়োজকেরা ছোট্ট করে একটা জমায়েত করল। সবার লেখা পড়তে পড়তে একটা রসাত্মক লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম। লেখক সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। নিজেই রসিয়ে রসিয়ে লেখাটা পড়ে শোনালাম সবাইকে। লেখকের নাম পরে শুনিয়েছিলাম ঠিকই তবে তখনও জানতাম না এই লেখক আসলে কে।

বুয়েটের অনুজপ্রতিম ইমুর কাছ থেকে জেনেছিলাম মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের কথা- ‘ভাই, ও একটা কঠিন জিনিস!’ জেনেছিলাম সে পাইয়ের মান ২৩৩৮ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারে। আমরা গণিত অলিম্পিয়াডের ক’জন মিলে সে সময় পাই নিয়ে একটা বই লেখার পরিকল্পনা করছিলাম। এজন্য তার সাথে কথা বলার আগ্রহ জাগে।

হিমালয়ের কাছ থেকেই তার সামহোয়্যার ইনের ব্লগের খবর পাই- ওর লেখা পড়ে অবাক হই। মুখে মুখে বিরাট বিরাট গুণ করে ফেলা, বিশাল লেখা ছবির মতো মনে রাখা- এমনসব অদ্ভুত ক্ষমতার কথা শুনে বিস্ময় জাগে। তবে সামনাসামনি পরিচিত হতে আরও কিছুদিন অতিবাহিত হয়।

আমি বুয়েটে পাস করার পরে কিছুদিন পাই ল্যাবসে চাকরি করি। সেখানে হিমালয়ের যাতায়াত শুরু হয়েছে, তখন হিমালয় আমার কাছে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা! তার মাথায় নানান রকম নাটকের পরিকল্পনা। একবার প্রতিষ্ঠানের কর্ণধর প্রিয় সোহাগ ভাই (মাহমুদুল হাসান সোহাগ, সহপ্রতিষ্ঠাতা, অন্যরকম গ্রুপ্স)মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য একটা গান লিখতে বললেন হিমালয়কে। হিমালয় লিখল, সুর করলাম আমি। রেকর্ডিং করা হলো শিরোনামহীনের স্টুডিওতে। পুরো প্রক্রিয়ায় ও সাথে ছিল। এরপর গানটার মিউজিক ভিডিও করার জন্য সারাদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে শ্যুটিং করলাম আমরা। হিমালয় সেখানে পরিচালকের ভূমিকায়।পাশাপাশি তার গল্প লেখার প্রতিভার কথা জানলাম- ‘প্রযত্নে হন্তা’ নামে একটা গল্প পড়ে অবাক হলাম লেখার বলিষ্ঠতা এবং সাবলীলতা দেখে।

ও আমাকে বলেছিল বহু সময় নিয়ে একটা বই অনুবাদ করেছে যেটা ভাষাচিত্র প্রকাশনী থেকে বের হবে। মনে আছে বইমেলায় গিয় খোঁজ নিয়েছিলাম বইটা এসেছে কিনা। পাইনি। পরে জেনেছিলাম প্রকাশনী তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে তার বৃত্তান্ত।

হিমালয়ের সঙ্গে সামনাসামনি যোগাযোগ বললে এর বেশি কিছু মনে করতে পারি না, কারণ এর অল্প দিন পরেই আমি দেশের বাইরে আসি লেখাপড়ার জন্য। তবে আত্মিক যোগাযোগ একটা আলাদা বিষয় এবং সময়ের পরিমাণ দিয়ে এর তীব্রতা বিচার করা যায় না। খুব অল্প সময়ে ওর সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাই ল্যাবসে থাকতেই আমি ‘A cartoon guide to genetics’ বইটার অনুবাদ শুরু করি। বইটার অনুবাদে সে আমাকে নিয়মিত তাগাদা দিত। দেশের বাইরে আসার পর অনুবাদটা শেষ করি। তখন প্রকাশের ঝক্কি ঝামেলা অনেকটা সে পোহায়। ‘গল্পে জল্পে জেনেটিক্স’- বইটার নামটাও হিমালয়ের দেয়া। দেশের বাইরে আসার পর বছরখানেক খুব স্বাভাবিক যোগাযোগ ছিল আমাদের। এরপর একটা অপ্রীতিকর কারণে আমাদের যোগাযোগ কিছুটা কমে আসে। সেটা অবশ্য কাটিয়ে উঠতেও আমাদের খুব সময় লাগেনি।

দেশের বাইরে থেকে যখন হিমালয়ের ‘প্রযত্নে হন্তা’ বইটার প্রকাশ সংবাদ পাই, খুব খুব খুশি হয়েছিলাম। বইটা পড়ার আগ্রহ জানিয়ে একটা নোট লিখেছিলাম, মনে আছে। ও যেহেতু আগে একাধিবার বই প্রকাশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে, বই প্রকাশ হওয়া নিয়ে ভালোলাগাটা বেশি ছিল। এরপর প্রকাশিত হয় হিমালয়ের সেই অনুবাদটা যেটা আগে প্রকাশ করতে চেয়েও পারেনি- ‘আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’। আমাকে অবাক করে সেই বইটা হিমালয় আমাকে উৎসর্গ করে। এটা আমাকে উৎসর্গ করা একমাত্র বই। হায়, ছয় বছর ধরে জমিয়ে রেখেছি বইটা পড়ব বলে, এখনও পড়া হয়নি! হিমালয়ের প্রথম বই ‘প্রযত্নে হন্তা’র সবগুলো গল্প ভালো লাগেনি, তবে এর পরের গল্পগ্রন্থ ‘বীক্ষণ প্রান্ত’ দারুণ লেগেছে। ও লেখক হিসেবে পরিণত হয়েছে।

আগের পর্ব পড়তে : ‘মানুষ’ নামক স্যাম্পলের ব্যাপারে উনার খুবই ভালো জ্ঞান আছে

হিমালয়ের চরিত্রের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার বোধহয় মানুষ পর্যবেক্ষণ। তিন হাজার মানুষের ইন্টারভিউ নেয়াটা দারুণ ব্যাপার। তবু সংখ্যাটা ঈর্ষণীয়। ও জনপ্রিয়তা উপভোগ করে, কারণ বেশি মানুষের মতামতের স্যাম্পল পাওয়া যায়। ও যে বিশ্লেষণ বা নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে তাতে জনপ্রিয়তা ব্যাপারটা সহজ না, তবে এরই মাঝে সে একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছে যারা ফেসবুকে ওর নানা বিশ্লেষণধর্মী লেখাগুলোর জন্য অপেক্ষা করে। এই লেখাগুলো পড়তে ভালো লাগে, ওর স্বকীয় ঢং এর জন্য। তবে যৌক্তিক বিচারে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই লেখাগুলোর অনেক ভক্ত না। খুব অল্প উপাত্ত থেকে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসার প্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া নিজ আবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে যুক্তিগুলোতে নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলার ঝোঁকও লক্ষ্য করা যায়।

তবে নিখুঁত মানুষ কেই বা আছে? এই দুর্বলতা বরং উপেক্ষা করা যায়, লেখালিখিগুলোর শক্ত দিকগুলোর জন্য। ভিন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে দেখার চেষ্টা, কোনো কিছুকে আপ্তবাক্য ধরে না নিয়ে বিচারের নিক্তিতে মাপার চেষ্টা, আপাত সংযোগহীন ব্যাপারগুলোকে যুক্ত করা- এমন অনেকগুলো দারুণ দিক রয়েছে ওর লেখায়। আর রয়েছে বিষয়বস্তুর দারুণ বৈচিত্র্য।

চমক

ক্রিকেট নিয়ে ওর লেখালিখি এখন খুবই জনপ্রিয়- এর বাইরেও বাংলা গান, চলচ্চিত্রের জগত, রাস্তার ট্যাক্সি চালক- সবাই তার আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। ওর তালিকায় প্রচুর আকর্ষণীয় মানুষ আছেন, যাদেরকে নিয়ে বিশ্লেষণ হয়নি কখনও। ডিপজল এবং তার হিউমারকে নিয়ে বিরাট বিশ্লেষণধর্মী লেখা আপনি আর কারো থেকে পাবেন বলে মনে হয় না।

হিমালয়ের ‘নামহীম দামহীন’ বইটা নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল ছিল। এটা মূলত ওর জীবনের গল্প, জীবনদর্শনের আখ্যান। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, হিমালয় এক প্রকারের ডিলিউশনের মধ্যে থাকে। সে তার সেই কাল্পনিক অস্তিত্বের ব্যাপারে দারুণভাবে সচেতন, তবু প্রায়ই বাস্তবতা থেকে তাকে আলাদা করতে পারে না। তার সেই ভ্রান্তিময় পৃথিবীতে হিমালয় মানুষকে কীভাবে দেখে, সেটা জানার সুতীব্র কৌতূহল আমার ছিল। মানবজাতির পথচলা, তাদের আবেগ অনুভূতি হিমালয় কীভাবে প্রত্যক্ষ করে, সেটা দেখতে চেয়েছি। এবং অবশ্যই জীবন, সমাজ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমারও নিজস্ব কিছু ভাবনা আছে, আমার ভাবনাটা তার ভাবনার সাথে মিলিয়ে নিতে চেয়েছি। কোন জীবনটাকে হিমালয় অর্থবহ জীবন ভাবে, কোনটাকে অর্থহীন, এটাও আমার আরেকটা আগ্রহের জায়গা ।

হিমালয়ের বইটা পড়েছি প্রায় দেড়বার। বইয়ের খুব মোটাদাগে বললে বইটাকে লেখকের আত্মজীবনী বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে বইটার বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা সম্পর্কে তিলমাত্রও ধারণা করা যাবে না। খুব নির্মোহভাবে এই বইটার পাঠ-প্রতিক্রিয়া লেখা আমার জন্য অসম্ভব, কারণ এখানে আমার নিজের সম্পর্কে অনেককিছু রয়েছে । সেগুলো পড়তে গিয়ে কখনো আনন্দ পেয়েছি, কখনও সামান্য বিব্রতবোধ করেছি।

বইটার খুবই আলাদা ধরনের একটা বই, কোনো চেনা নিয়ম মেনে লেখা বই বলা যাবে না এটাকে। বিজ্ঞানবিভ্রান্তি, আত্মরতি, এলোমেলোভাব এগুলো বাদ দিলে বইটা দারুণ। বইয়ের আলাদা গতি আছে, আছে দারুণ ভাষার কাজ, কখনও সখনও ডার্ক হিউমারের চর্চা, এবং তীক্ষ্ণ জীবনবোধ থেকে উৎসারিত দর্শন।

দার্শনিকতায় সমৃদ্ধ এই বইটি ‘উপন্যাস প্রকাশন’ থেকে পুনর্মুদ্রণ হবে জেনে খুশি হয়েছি। আরও অনেক মানুষের কাছে বইটি পৌঁছে যাক- বইয়ের জন্য এবং তাঁর লেখকের জন্য শুভকামনা রইল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড