রিয়াজুল ইসলাম, কুষ্টিয়া
দীর্ঘ ২২ বছর যাবত নিঃসন্তান কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খাজানগর চাষি ক্লাবপাড়া এলাকার সাইফুল ইসলাম ও কাজলী আক্তার দম্পতি। সংসারে সুখের কোনো অভাব ছিল না। তবে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ কোনো সন্তান না হওয়ায় হতাশায় ভুগছিলেন এই দম্পতি।
চিকিৎসার সব রকম চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। আর সন্তান হবে না জেনে অনেক দিন ধরে একটি সন্তান দত্তক নেয়ার জন্য অনেকের কাছেই ধর্না তারা। অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাদের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি দেয়ায় চোখেমুখে ফুটতে থাকে আনন্দের হাসি। মাত্র ছয় হাজার টাকায় দত্তক নেন এক নবজাতক মেয়ে শিশু। তবে তাদের এই বাঁধভাঙা আনন্দের স্থায়িত্ব হয় মাত্র ১৪ ঘণ্টা। শনিবার সকালে তাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। ভোর ৫টার দিকে বাড়ির মধ্যে পুলিশ ঢুকে নিঃসন্তান দম্পতিকে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। পরে পরিবারের লোকজন জানতে পারেন দত্তক নেয়া শিশুটি চুরি করে নিয়ে এসে বিক্রি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় নিঃসন্তান দম্পতি সাইফুল ইসলাম ও কাজলী আক্তারের বাড়িতে এক মহিলাকে সাথে নিয়ে আসেন স্থানীয় মনসুর ঘটক নামের একজন ব্যক্তি। মহিলার কোলে একটি নবজাতক মেয়ে শিশু ছিল। এ সময় ওই মহিলা জানান তার আরও দুইটি সন্তান আছে। নবজাতকটি তার তৃতীয় সন্তান। কয়েকদিন আগে সন্তানটি হয়েছে। স্বামী তাকে কোনো ভাত কাপড় দেয় না। তার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই এই নবজাতককে দত্তক অথবা বিক্রয় করতে চান। একথা শুনেই খুশিতে ফেটে পড়েন নিঃসন্তান কাজলী আক্তার।
কত টাকা চান জিজ্ঞাসা করলে ওই মহিলা বলেন, যা দিবেন তাই নিবো। মোট আট হাজার টাকায় মিটমাট হলে তাৎক্ষনিক ছয় হাজার টাকা নিয়ে মহিলা চলে আসেন। শনিবার সকালে আরও দুই হাজার টাকা নিতে আসার কথা ছিল ওই মহিলার।
সাইফুল ইসলামের ভাগ্নে জাহিদ হাসান জনি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থানীয় ঘটক মনসুর ওই মহিলাকে নবজাতকসহ মামার বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ নাহার ক্লিনিকের সামনে ওই মহিলা নবজাতক শিশুকে নিয়ে বসে ছিলেন। এ সময় মনসুর ঘটকের সাথে ওই মহিলার পরিচয় হয় বলে জানিয়েছিলেন মনসুর ঘটক। শনিবার ভোরে জানতে পারি শিশুটি চুরি করে আনা হয়েছে।
জাহিদ হাসান জনি অভিযোগ করে বলেন, কোনো মহিলা পুলিশ ছাড়াই মামিকে পুরুষ পুলিশ জোরপূর্বক টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। এ সময় মামি বারবার টয়লেটে যেতে চাইলে পুলিশ যেতে দেয়নি।
পুলিশ জানায়, শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নাটোর সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে নবজাতক শিশুটি চুরি হয়। নার্স পরিচয় দিয়ে এক নারী দাদি খাউরুন নাহারের কোলে থাকা শিশুটিকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে চুরি করে নিয়ে যায়। চুরি হওয়া নবজাতকটি নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের মহিষডাঙ্গা গ্রামের মাহফুজুর রহমান পলাশ ও হাসনা হেনা শিল্পী দম্পতির প্রথম সন্তান।
শনিবার ভোরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কুষ্টিয়ার খাজানগর এলাকা থেকে নবজাতক মেয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে। এসময় চুরি হওয়া শিশুসহ নিঃসন্তান দম্পতি সাইফুল ইসলাম ও কাজলী আক্তারকে আটক করে নিয়ে যায় নাটোর জেলা পুলিশ। পরে কাজলী আক্তারকে গ্রেফতার দেখিয়ে সাইফুল ইসলামকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
এর আগে নার্সের ছদ্মবেশে নাটোর আধুনিক হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে চুরির দায়ে একই এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলামের স্ত্রী কাজলী খাতুনকে গ্রেফতার পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিশু চুরির দায় স্বীকার করে শিশুটির ক্রেতা কাজলীর বাড়িতে আছে বলে দেখিয়ে দেয় পুলিশকে। এ ঘটনায় শিশু চুরির অভিযোগ এনে দুইজনের নামোল্লেখ করে নাটোর সদর থানায় মামলা করে ওই শিশুকন্যার পিতা নলডাঙ্গা উপজেলার মহিষযাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রসব বেদনা নিয়ে নাটর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হন হাসনা হেনা নামে প্রসূতি মা। ওই বিকালে শিশুকন্যার জন্ম দেয় হাসনা হেনা। পরদিন শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নার্স পরিচয় দানকারী এক নারী শিশুটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলে সদ্যোজাত শিশুটির দাদি খাইরুন নাহারের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এ ঘটনায় হাসপাতাল এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। পরে শিশুটির পিতা নাটোর সদর থানায় জানালে থানা পুলিশ অভিযানে নামে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নাটোর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক নাসিম আহমেদ জানান, শুক্রবার বিকালে আমরা জানতে পারি শিশু চুরির ঘটনাটি। তাৎক্ষনিক ভাবে হাসপাতালের সিসি ফুটেজ দেখে প্রাথমিকভাবে চুরির সাথে জড়িত কাজলী খাতুন নামের এক নারীকে সনাক্ত করতে সক্ষম হই। পরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে চুরি যাওয়া শিশুটি কুষ্টিয়ার খাজানগর এলাকায় আছে। সেই সূত্র ধরেই কুষ্টিয়া পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে মাত্র দুই দিনের সদ্যজাত চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে শিশুটিকে চুরির অভিযোগে কাজলী খাতুন নামে এক নারীসহ শিশুটি ক্রেতা হওয়ার দায়ে কাজলী আক্তার নামের অপর নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা এরা সংঘবদ্ধ শিশু চোর বা পাচারকারী চক্রের সদস্য হয়ে থাকতে পারে। এই চক্রের সাথে আরও কেউ জড়িত আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কুষ্টিয়া মডেল থানার (ওসি) তদন্ত জহুরুল ইসলাম বলেন, মূলত অভিযানে নাটোর জেলা পুলিশের টিম কাজ করেছে। এই অভিযানে সহযোগিতা করেছে কুষ্টিয়া পুলিশের সদস্যরা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড