জে রাসেল, ফরিদপুর
বাপু কানতে কানতে (কাঁদতে কাঁদতে) আজ চোখ কানা হয়ে গেছে। এই অত্যিআচার (অত্যাচার) আজ ১০-১৫ পনেরোডা বছর। এখান থেকে আমাদের চলে যেতে বলে। কোন জায়গা যামু আমি এ্যাহেন্নে (এখন)। আমি জমিনডায় কত বছর যাবত খাইতেছি। আমার দাদা হশুুরের (শ্বশুরের) বাপের আমল থেকেও। এহন কি করমু।
প্রতিবেশীর অত্যাচারে বসতঘর হারানোর শঙ্কায় এভাবেই বিলাপ করতে করতে আবেগাপ্লুত হয়ে যান ষাটোর্ধ জহুরা বেগম। তিনি ফরিদপুর জেলা সদরের চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের হাফেজডাঙ্গী গ্রামের মৃত দ্বিরাজদ্দিন শেখের স্ত্রী। স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে একমাত্র ছেলে আদিল শেখের সঙ্গেই তিনি থাকেন। এই জায়গায় বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তারা।
জায়গাটি দখলে নিতে একই এলাকার মিন্টু পালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আদিল শেখের পরিবার। শুধু আদিল শেখ নয়, প্রায় ২০টি পরিবার এই শহিদুজ্জান মিন্টু পালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার অত্যাচারে ইতোমধ্যে স্বল্পমূল্যে জমি বিক্রয় করে অন্যত্র চলে গেছেন একই বাড়ির মোতালেব শেখ।
সরেজমিনে দেখা যায়- হাফেজডাঙ্গী গ্রামে দুই একরের বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে খামার বাড়ী এগ্রো নামে পোল্ট্রির খামার। যার তিনদিকেই রয়েছে ঘনবসতি। শুধু তাই নয়, কিছুদিন পূর্বে স্থাপন করা হয়েছে প্যারাগন ফিড নামে পোল্ট্রির খাবার উৎপাদনের কারখানা। বসানোও হয়েছে একটি মেশিন। যার শব্দে অতিষ্ঠ শিশু থেকে বয়স্করা।
এই খামারের বর্জ্য ফেলানো হচ্ছে পাশেই। এমনকি কবরস্থানের উপরও ফেলানো হচ্ছে বর্জ্য। যার ফলে খামারের ময়লার গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আশপাশের অন্তত ২০টি পরিবার। ডায়রিয়াসহ নানা রোগ-শোকেও ভুগছেন তারা।
জানা যায়- প্রায় ১০ বছর পূর্বে ঘনবসতির মাঝে কিছু জায়গা ক্রয় করে পোল্ট্রির খামার গড়ে তোলেন হাফেজডাঙ্গী গ্রামের শাহজাহান পালের ছেলে শহিদুজ্জামান মিন্টু পাল। ধীরে ধীরে তিনি কৌশলে আশপাশের জায়গা নিজের কব্জায় নিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে জায়গা বিক্রি করতে বাধ্য হোন জমির মালিকেরা। এভাবে তিনি নিজের কব্জায় নিয়েছেন দুই একরের বেশি জায়গা।
বর্তমানে খামার সংলগ্ন বৃদ্ধ জহুরা বেগমের ছেলে আদিল শেখ ও হাজেরা বেগমের পরিবারকে জায়গা বিক্রয় করে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। তার অত্যাচারে বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে একটি পরিবার। খামারের আশপাশে কয়েকটি পরিবারকেও চলে যেতে বিভিন্ন সময় চাপসৃষ্টি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী আদিল শেখের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন- আমরা এখানে ৪ পুরুষ ধরে বসবাস করে আসছি। আমাকে উঠায় দেয়ার জন্য জোর-জুলুম করতেছে। আমি সন্তানদের নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। এই পোল্ট্রির ফার্মের গন্ধে বাচ্চাদের ডায়রিয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে গন্ধে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া লাগে। মিন্টুর অত্যাচারে এরমধ্যে দুই-একটি পরিবার এখান থেকে চলেও গেছে। কিন্তু আমার থাকার মতো কোনো জায়গা নেই।
তিনি আরও বলেন, কোথাও যাইতে পারতেছি না। অনেক কষ্টে আছি এখানে। আমার অন্য কোথাও জায়গা থাকলে ওদের অত্যাচারে এতদিন চলে যেতাম। কি কষ্ট আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না। এখানে আবার ফিড মিল দিছে। যখন মেশিন চালায়, শব্দে থাকাই যায় না। আমি অনেক জায়গা শালিস করার জন্য বলেছি কিন্তু উল্টা আমার উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। মিন্টুর সামনে আমি কথা বলতে পারি না।
তার দাবি, ইদানীং আমারে হুমকি দিতেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে চলে যেতে বলতেছে। না সরলে বলতেছে- একটা মেজের কাটি দিয়ে আগুন ধরায় দিবো। এখন আমি রাতে পরিবার নিয়ে শান্তিতে ঘুমাতেও পারি না। কখন যে কি করে ফেলে এই ভয়ে থাকি। আমি এর সঠিক ফয়সালা চাই।
এ সময় কথা হয় মোকছেদ সেখের স্ত্রী ষাটোর্ধ হাজেরা বেগমের সাথে। তিনি বলেন- বাতাস ছাড়লে গন্ধে কেউ বাড়িতে টিকতে পারে না। যে সময় মাছি হয়, মাছির জন্য বাড়িতে থাকা যায় না। মাছি ভাতের মধ্যে গিয়ে পড়ে, তরকারির মধ্যে গিয়ে পড়ে। এভাবে থাকা যায় নাকি। এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমার ছোট দেওর শেখ মোতালেব বাড়ির জায়গা ওদের দিয়ে চলে গেছে। এখন আমাদেরও চলে যেতে বলে।
তখন আরও কথা হয় হায়দার শেখের স্ত্রী ফরিদা বেগম ও রশিদ শেখের স্ত্রী জোসনা বেগমের সাথে। তারা বলেন- আমাদের ঘরের পেছনে পায়খানা (পোল্ট্রির বর্জ্য) নিয়ে ফেলায়, তখন প্রচুর গন্ধ হয়। এজন্য পোলাপান ঠিকমতো পড়ালেখাও করতে পারে না। মেশিনের শব্দে দিনে একটু ঘুমাতেও পারি না। গন্ধে আমরা ভাত পর্যন্তও খাইতে পারি না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই মিন্টু পালের বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর। অসচ্ছল পরিবারের মাঝে বেড়ে উঠা তার। ছোট সময়ে মিন্টু পাল একটি এতিম খানায় পড়ালেখা করেন। এরপর ২০০১ সালে ফরিদপুর মুসলিম মিশনের খামার দেখাশোনার দায়িত্ব পান। বর্তমানে তিনি সেখানে ম্যানেজার হিসেবে রয়েছেন।
এলাকাবাসীর প্রশ্ন, সেখানে তিনি কত টাকাই বেতন পান? ধীরে ধীরে এলাকার অনেক জমি ক্রয় করে নিতেছে। এতো টাকা কোথায় পাচ্ছে?
এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয় শাহিদুজ্জামান মিন্টু পালের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন- আমি জায়গা ক্রয় করে ফার্ম করেছি। বর্তমানে দুই একরের বেশি জায়গা রয়েছে। এ বিষয়ে এলাকার চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সকলের নিকট থেকে অনুমতি নেয়া হয়েছে। পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি, এখনো পাইনি। এছাড়া জমিগুলো আমিসহ আমার ভাই শামসুল হক পাল ও মনিরুজ্জামান ক্রয় করেছে।
বর্তমানে আদিল শেখের মাত্র ৪.৭৫ শতাংশ জায়গা রয়েছে। তার শরিকদের নিকট থেকে জায়গা কিনেছি। ভেজাল করলে তার শরিকেরা করেছে। আদিলের জায়গা কেনার জন্য কোনো প্রস্তাবও দেইনি।
এসব বিষয়ে কথা হলে ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন ঢালী বলেন, চরমাধবদিয়া এলাকায় জনবসতি এলাকায় মুরগির খামার ও খাবার তৈরির কারখানার বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। আমরা দ্রুতই ঐ এলাকার চেয়ারম্যান এবং মেম্বরকে নিয়ে পরিদর্শন করবো। যদি অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে, আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড