• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

এখানে নীলচাষিদের রক্তের দাগ মুছে যায় গরু-ছাগলের রক্তে

  শাহারিয়ার রহমান রকি, ঝিনাইদহ

২৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৪৩
মহেশপুর
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহেশপুরের নীলকুঠি (ছবি : দৈনিক অধিকার)

অনেক বছর আগেই এ উপমহাদেশ থেকে অবসান হয়েছে ইংরেজ শাসনের। এখন আর হয় না নীল চাষ। তবুও তাদের শাসনামলের নীল চাষের অনেক ইতিহাস ও স্থাপনা রয়ে গেছে। যার একটি নিদর্শন ঝিনাইদহের মহেশপুরের খালিশপুরের নীলকুঠি।

স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একবার নীলকুঠি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মহেশপুরের সুন্দরপুরের জমিদাররা বাধা দিলে সেটি আর ভাঙা সম্ভব হয়নি। সংস্কার বা যত্ন না নেওয়ায় নীলকুঠি আজ একেবারেই ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। ময়লা আবর্জনা কিংবা পশু জবাইয়ের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, ১৮১১ সালে জেলার কোটচাঁদপুর দুতিয়ার কাঠি কুঠির মালিক মি. ব্রিজবেন মহেশপুরের খালিশপুর কপোতাক্ষ নদী তীরে কুঠিরটি স্থাপন করেন।

সে সময় খালিশপুর থেকে সাগরদাঁড়ি হয়ে কলকাতা পর্যন্ত লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করত। তৎকালীন খালিশপুরের কুঠির কাচারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কলকাতা থেকে অনেক কুঠিয়াল সাহেব নদী পথে কাচারি বাড়িতে আসতেন। এক সময় বৃহত্তম যশোর জেলায় অনেক ইংরেজ নীল ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে।

কারণ বৃহত্তম যশোর-ঝিনাইদহ জেলার মাটি নীল চাষের জন্য উপযোগী ছিল। এই অঞ্চলের এনায়েতপুর, নগরবাথান, মধুপুর, ঝিনাইদহ, হাজরাতলা, কলোমনখালী, কালীগঞ্জ, শৈলকুপার বিজুলিয়া, হরিণাকুন্ডুর জোড়াদাহ, ধুলিয়া, কোটচাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজরা নীল চাষ শুরু করে। আর এ এলাকার সাঁওতাল সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন ছিল নীল চাষের শ্রমিক।

সেই সময় ইংরেজরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে খাজনা আদায়ের জন্য নীলকুঠির স্থাপন করেন। তার একটি ছিল খালিশপুর নীল কুঠির। মহেশপুর এলাকায় যত নীল চাষ হতো তার খাজনা আদায় করা হতো এখানে।

স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এটি সরকারি মালিকানাধীন, খালিশপুরের ৯১৩ দাগের ১১ একর ২৪ শতক জমির ওপর অবস্থিত।

দক্ষিণমুখি কুঠির ভবনের দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট, প্রস্থ ৪০ ফুট ও উচ্চতা ৩০ ফুট। দক্ষিণ দিকে প্রশস্ত বারান্দা। ১২টি কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন এটি। নিচের তলা থেকে উপরের তলার কক্ষগুলো আয়তনে বড়। চুন, শুড়কি ও পাকা ইটের তৈরি।

কুঠিরের নিচ তলায় ছিল নীল চাষের খাজনা আদায় ও নির্যাতন কক্ষ, দ্বিতীয় তলায় আদায়কারীরা রাত্রিযাপন করতেন। বিশ্রাম ও গোসল করার জন্য নির্মিত পাকা সিঁড়ি কপোতাক্ষ নদীর তীর পর্যন্ত নামানো।

নীল কর সাহেবরা মাঠে নীল চাষ দেখতে বেশির ভাগ সময় ঘোড়ায় চড়ে এলাকায় যাতায়াত করতেন। কষ্টকর ও নির্যাতনমূলক নীল চাষ করতে এলাকার কৃষকরা এক পর্যায়ে অনাগ্রহ প্রদর্শন শুরু করে।

১৮৬০ সালের দিকে এ অঞ্চলে নীল চাষের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকরা বিদ্রোহ করে। লঞ্চযোগে ভ্রমণের সময় হাজার হাজার কৃষক ইংরেজ ছোট লাট গ্রান্ট সাহেবকে কুমার ও কালী নদীতে ঘেরাও করে এবং নীল চাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করে।

সরকার ১৮৬০ সালেই নীল কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই নীলকর সাহেবরা এই নীলের চাষ আবার শুরু করেন।

ন্যায্য মূল্য না দেওয়া ও বাধ্যতামূলক নীল চাষ করানোর প্রতিবাদে এ অঞ্চলের কৃষকরা নীল চাষে আবারও অনাগ্রহ দেখায় এবং বিদ্রোহ করতে থাকে। তখন ইংরেজ নীলকররা ভারতের বিহার প্রদেশের ছোট নাগপুর ও বিভিন্ন স্থানের সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের এনে শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন নীলকুঠিতে কাজে লাগায় এবং নীল চাষে অনাগ্রহী ও খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে চাষিদের বিভিন্ন সময় ধরে এনে কুঠিরের ভিতরে টর্চার সেলে এনে নির্যাতন করা হতো।

পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর কিছুদিন হিন্দু জমিদাররা এখানে খাজনা আদায় করেছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে নীল চাষের অবসান হলেও আজ নীলকুঠি সেই সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্থানীয় বৃদ্ধ শুকুর আলী জানান, এই নীল কুঠিরের ভেতর বিভিন্ন সময় ইংরেজরা নিরীহ চাষীদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন করত। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে কোনো চাষি রক্ষা পেত না।

তিনি আরও জানান, আজ সেই নীল কুঠি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কোন সংস্কার নেই। কুঠিরের ভিতরে মানুষ ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখে। খালিশপুর বাজারের মাংস বিক্রির সকল পশু এখানে জবাই করা হয়। দুর্গন্ধে ভিতরে যাওয়া যায় না। সরকারের উচিত ইংরেজ আমলের এই ইতিহাস রক্ষার জন্য নীল কুঠিরটি সংরক্ষণ করা।

ওডি/এমবি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড