• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘রাজনীতি এখন মানুষের মধ্যে নেই, চলে গেছে গাছের ডালে’

  কামরুজ্জামান সেলিম, চুয়াডাঙ্গা

২৯ আগস্ট ২০১৯, ১২:১৯
চুয়াডাঙ্গা
গাছে ঝুলছে বিভিন্ন সাইনর্বোড (ছবি : দৈনিক অধিকার)

চুয়াডাঙ্গার গাছে গাছে ঝুলছে সাইনবোর্ড, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড। লোহার পেরেক ঠুকে এগুলো টাঙানো হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোচিং বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে এসব গাছগুলোতে। রাস্তার পাশে গাছ থাকলেই তাতে টাঙানো হচ্ছে সাইনবোর্ড, ব্যানার কিংবা প্ল্যাকার্ড। গাছে পেরেক ঠুকে এসব লাগানো আইন সম্মত না হলেও তা কেউ মানছে না। গাছ কোনো জড়বস্তু নয়। গাছেরও প্রাণ আছে। একেকটা গাছ একেকটা অক্সিজেনের কারখানা। এরপরও নিজের কিংবা ব্যবসায়িক প্রচারণার জন্য আইনের তোয়াক্কা না করে অনেকেই গাছে পেরেক মেরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও দৃষ্টিকটু।

চুয়াডাঙ্গা শহরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, সব গ্রামেই রাস্তার পাশে থাকা গাছে পেরেক দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। সাইনবোর্ডে পরিমাণ বেশি দেখা গেছে প্রধান সড়কগুলোর পাশের গাছগুলোতে। চুয়াডাঙ্গা থেকে জীবননগর পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো সব গাছেই আছে পেরেকবিদ্ধ সাইনবোর্ড। ঝিনাইদহ, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া রোডেও। অন্য সড়কগুলোতেও গাছে গাছে সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।

বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ অবস্থা তৈরি হয়েছে পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকে। এর আগে হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া খুব বেশি সাইনবোর্ড চোখে পড়ত না। দুই বছর আগে থেকে গাছে সাইনবোর্ড বেশি চোখে পড়ছে। নববর্ষ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষেও রাজনীতিবিদদের শুভেচ্ছা সাইনবোর্ড দেখা গেছে। অন্যান্য দিবস উপলক্ষেও নতুন নতুন সাইনবোর্ড গাছে ঝুলিয়ে থাকেন রাজনীতিবিদরা।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুবক বলেন, যারা মানুষকে সচেতন করবেন, তারা নিজেরাই গাছে পেরেক ঠুকে নিজেদের অসচেতনতার পরিচয় তুলে ধরেছেন।

গাছে ঝুলছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যানার (ছবি : দৈনিক অধিকার)

চুয়াডাঙ্গার শোভা নার্সারির মালিক হেলাল হোসেন জোয়ার্দার বলেন, গাছের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা কষ্ট দায়ক। গাছ পরিবেশ ও মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। গাছে পেরেক ঠুকে আমরা নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছি সেই বন্ধুর প্রতি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হিজলগাড়ি গ্রামের মজিবর রহমান বলেন, রাজনীতি এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। তা গাছের ডালে চলে গেছে। সব গাছেই রাজনীতিবিদদের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে পরিচিতি নেই, কিন্তু গাছের ডালে ঠিকই ঝুলছেন তিনি। যেহেতু আইন আছে সেহেতু এসব সাইনবোর্ড প্রশাসন তুলে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে।

চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি বলেন, ভুল বানানে লেখা সাইনবোর্ড, প্ল্যাকার্ড গাছে গাছে ঝুলছে। ফলে সাইনবোর্ড দেখে ভুল বানান শিখছে শিক্ষার্থীরা। গাছে পেরেকবিদ্ধ করে বেআইনিভাবে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছি আমরা। রাজনীতিবিদরা ছাড়াও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি অবৈধভাবে আর্থিক লাভের আশায় নিম্নমানের পণ্যের বিজ্ঞাপন গাছে পেরেক মেরে প্রচার করছে। কোনো ভালো প্রতিষ্ঠান এভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করে না। এসব বিজ্ঞাপনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা সবাই। তাই প্রশাসনিকভাবেই এসব সাইনবোর্ড অপসারণ করা দরকার।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। পেরেক মারার কারণে ছোট গাছগুলো মারাও যেতে পারে। ক্ষতি হতে পারে বড় গাছের। পরিবেশ রক্ষার জন্য যেমন পাখি নিধন নিষেধ, তেমনি গাছের ক্ষতি করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতে বৃক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশকে দূষিত করছে। গাছ বা বৃক্ষ সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে অক্সিজেন ত্যাগ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা করছে।

গাছের পুরা শরীর ঢেকে দিয়েছে সাইনবোর্ড দিয়ে (ছবি : দৈনিক অধিকার)

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ফারুক হোসেন বলেন, গাছের ভেতরে পরিবহন সিস্টেম দুইটি। একটি হলো জাইলেম আর আরেকটি হলো ফ্লোয়েম। পানির সঙ্গে দ্রবীভূত খনিজ লবণও জাইলেম টিস্যুর মাধ্যমে ওপরে প্রবাহিত হয়। আবার গাছের পাতা থেকে যে খাদ্য তৈরি হয় সেটা আবার গাছের বাকলি দিয়ে ভেতরে থাকে সেটা হলো ফ্লোয়েম। পাতা থেকে সেটা গাছের নিচে দিয়ে আসে এবং সারা গাছে যায়। এখন যদি কোনো ধরনের পেরেক মেরে দেন, তাহলে ফ্লোয়েম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে পাতায় উৎপাদিত খাদ্য রুটে যেতে পারবে না। সেটা যদি বড় পেরেক হয় এবং গাছের জাইলেম পর্যন্ত যায়। সেই ক্ষেত্রে গাছের ওপরে যে পানি উঠবে, খনিজ লবণ উঠবে, তা সেখানে বাধা প্রাপ্ত হবে। ফলে সে প্রয়োজনীয় পানিও খনিজ লবণ পাবে না।

তিনি আরও বলেন, গাছে পেরেক লাগানোর কারণে গাছের গায়ে যে ছিদ্র হয়, তা দিয়ে পানি ও এর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অণুজীব প্রবেশ করে। এতে গাছের ওই জায়গায় পচন ধরে। ফলে তার খাদ্য ও পানি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এর ফলে এক সময় গাছটি মরে যায়।

সামাজিক বন বিভাগ চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। গাছে এভাবে পেরেক ঠুকে পোস্টার বা ফেস্টুন লাগানো আইনত দণ্ডনীয়। এগুলো সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন। তবে, বনবিভাগ সামাজিক বনায়নের আওতায় গাছগুলোকে দেখা-শোনা করলেও বিলবোর্ড ফেস্টুন অপসারণ করার আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে আমরা সচেতন করি।

চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু বলেন, বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু। বৃক্ষ অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়, ফল-ফুল ও জ্বালানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। অতি দ্রুত অনুমতি ছাড়া গাছে গাছে টানানো বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের অবৈধ বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করা হবে।

ওডি/এমবি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড