আমিনুল ইসলাম জুয়েল, পাবনা
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় এ বছর প্রায় ১৪ হাজার বিঘা জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত লিচুর বাজার মূল্য প্রায় ৩শ কোটি টাকা। এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার লিচু চাষি রয়েছেন। চাষিরা সবচেয়ে বেশি আবাদ করছেন বোম্বাই জাতের লিচু। মূলত ঈশ্বরদীর বোম্বাই লিচুর কদরই দেশ জোড়া। অন্যান্য জাতের মধ্যে বেদানা, কদমী, মোজাফফরী, চায়না থ্রি, আঁটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, জয়নগর, মিরকামারি, চর মিরকামারি, মানিকনগর, বাবুল চড়া, কাঠালবাড়িয়া, চর গড়গড়ি, দাদাপুর, পাকুরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম এখন লিচুর আবাদ হচ্ছে। এসব এলাকার সড়ক বা মহাসড়ক ধরে গেলে রাস্তার দুই পাশে নয়নমনোহর থোকা থোকা রক্তিমাভ লিচুই শুধু উকি দেয়। লিচুর ফাঁকে ফাঁকে দুচারটি পাতাও চোখে পড়ে। এদিকে কামালপুর, চরকুড়–লিয়ার মতো বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলেও খুব দ্রুত গড়ে উঠছে লিচু পল্লী। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো ঈশ্বরদীর লিচু বিপ্লব কিছু লোভী লোকের কালো থাবার মুখে পড়েছে। যারা লিচু গাছে ক্ষতিকর হরমোন আর লিচু ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ করে সুস্বাদু লিচুকে অখাদ্যে পরিণত করতে ব্যস্ত। লিচুতে কেমিকেল মেশানোর ফলে সেটি এখন বিষে পরিণত হচ্ছে, যা আমাদের মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
নিজ বাগানের লিচু হাতে ‘লিচু সর্দার’ বলে খ্যাত রিয়াজ সর্দার (ছবি : দৈনিক অধিকার)
‘লিচু সর্দার’ বলে খ্যাত রিয়াজ সর্দার বলেন, ‘লিচু চাষ শুরু করেছিলাম বলে যে গ্রামের লোক তাকে পাগল বলত তারাই এখন তার পথ অনুসরণ করে বাগান করেছেন। বেকার যুবকেরা খামার করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। লিচু চাষ করে চাষিরা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলের বেলে-দোআঁশ মাটি ও আবহাওয়া লিচু চাষের জন্য খুব উপযোগী। ফলন ভালো ও গুণে মানে সেরা হওয়ায় ঈশ্বরদীর লিচুর কদরও দেশ জোড়া। ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরাও আগ্রহী হচ্ছে আবাদ করতে।
লিচু চাষে কৃষক এত আগ্রহী হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নে ঈশ্বরদীর লিচু চাষিরা জানান, অন্যান্য ফসল চাষ করে লাভ কম হওয়ায় চাষিরা লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়া লিচু চাষে জমি নষ্ট হয় না। বাগান করার প্রথম ৩-৪ বছর অন্যান্য ফসল পূর্ণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতেও সাথী ফসল হিসাবে হলুদ, তরমুজসহ অন্যান্য ফসল চাষ করা যায়।
ঈশ্বরদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। লিচু পাহারা, বাদুর তাড়ানো, লিচু উত্তোলন, বাছাই, বিক্রি, পরিবহন ইত্যাদি মিলিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক, ব্যাপারী, ফরিয়াদের এক মিলন মেলা বসেছে। লিচু ভোজনের উদ্দেশ্যে সব বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। লিচু চাষিরা একটি ইতিবাচক তথ্য দিলেন তা হলো- ঈশ্বরদীর লিচু বাগানে এলাকার কোন শ্রমিক নেই। কারণ প্রায় সবার বাড়িতেই লিচু গাছ। সবাই নিজের লিচু নিয়ে যেমন ব্যস্ত তেমনি স্বনির্ভরও বটে। ফলে অন্যের বাড়িতে তাদের আর মজুরি খাটতে হয় না।
এদিকে লিচু বাজারজাত করণের জন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝুড়ি, টুকরি ও ডালার বিশেষ প্রয়োজন। এজন্য এ মৌসুমে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকায় বাঁশের তৈরি এসব ঝুড়ি, টুকরি ও ডালা তৈরিরও ধুম পড়েছে। বক্তারপুর গ্রামের টুকরি তৈরির কারিগর জালাল হোসেন জানান, তার পরিবারের ছয়জন সদস্যের সবাই এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিচুর মৌসুম উপলক্ষে ৩ মাস ধরে তার গ্রামের ১শ টি পরিবার এ কাজ করছে বলে জানান তিনি।
কৃষি কর্মকর্তা (অব.) আ. খালেক একটি মজার তথ্য দিয়ে বলেন, এ অঞ্চলের বাদুরের উপদ্রব খুবই কম। যেখানে অন্য এলাকায় বাদুর এক রাতে গাছের লিচু সাবাড় করে ফেলে! এখানে এত হাজার হাজার লিচু গাছ যে, গাছ প্রতি মাত্র একটা লিচু দিলেও সেই পরিমাণে বাদুর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেজন্য নাকি অন্য এলাকার চাষিদের মতো এখানে চাষিদের পায়ে টিনের ঢোল বেঁধে গাছ তলায় শুয়ে থাকতে হয় না!
লিচু বাছাইয়ে ব্যস্ত শ্রমিকরা (ছবি : দৈনিক অধিকার)
লিচু চাষি রিয়াজ সর্দার বলছিলেন এক যুগ আগে, ব্যাপারীদের ডেকে নিয়ে আসতে হত ঈশ্বরদীর লিচু বাগানে। এখন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল থেকে ব্যাপারীরা আসছে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে আসা ব্যাপারী মাসুদ, আকবর, বাচ্চু, মোহাম্মদ আলী আমাদের বলছিলেন বাজারে ঈশ্বরদীর লিচুর কদরই এখন সবচেয়ে বেশি। তাদের দেওয়া তথ্য মতে একশ-দেড়শ ব্যাপারী এখন ঈশ্বরদীতে। সবচেয়ে ভালো লিচু ২০০০-২২০০ টাকায় আর মধ্যম মানের লিচু ১৫০০-১৬০০ টাকা দরে আর এর চেয়ে নিচু মানের লিচু আরও কম দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ ট্রাক লিচু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হচ্ছে।
লিচু চাষের সমস্যা- সম্ভাবনা নিয়ে উপজেলার খ্যাতিমান লিচু চাষি রিয়াজ উদ্দিন, গেদা প্রামানিক, বাদশা মিয়া বলছিলেন প্রধান সমস্যা প্রতিকুল আবহাওয়া। তারা জানান জনপ্রিয় ফল লিচু নিয়ে কোন গবেষণা নেই। লিচুর পরিচর্যার জন্য কোন আলাদা রাসায়নিক বাজারে পাওয়া যায় না। তারা জানালেন লিচু সংরক্ষণের কোন উপায় নেই। ২-৩ মাস সংরক্ষণ করা গেলে দীর্ঘ সময় এটি বাজারে পাওয়া যেত। এতে চাষি ও ভোক্তা উভয়েই লাভবান হত।
ভোক্তাদের অভিযোগ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর রাসায়নিক!
বোম্বাই জাতের লিচু এখন পাকছে। কিন্তু বাজারে উঠেছে আরও ১৫-২০ দিন আগে। পেকে যাওয়ার আগেই অপুষ্ট লিচুতে রাইপেন ব্যবহার করে নির্ধারিত সময়ের আগেই পাকিয়ে বেশি দামের আশায় বাজারে তোলা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন লিচু চাষি জানান। প্রখ্যাত লিচু চাষি রিয়াজ সর্দার ও কিতাব মন্ডল জানান, অনেকে লিচুর মুকুল আসার আগেই গাছে হরমোন স্প্রে করে বেশি করে মুকুল আনেন। এটা অনেকে করলেও তারা করেন না বলে জানান। প্রাকৃতিক ভাবে যেটুকু আসে তাতেই তারা সন্তুষ্ট। তবে তারা প্রাকৃতিক খাদ্য ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে ফলন বাড়ানোর চেষ্টা করেন বলে জানান তারা।
বিষ প্রসঙ্গে লিচু চাষি কিতাব মন্ডল জানান, সাইপারমেথ্রিন জাতীয় বালাইনাশক তারা প্রয়োগ করেন। যেটি শুধু পোকা তাড়ায়। এতে জনস্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না।
এদিকে খোজ নিয়ে জানা গেছে, ঈশ্বরদীর বিভিন্ন লিচু প্রধান এলাকায় কিছু চাষি ও ব্যাপারীরা এখন বেশি লাভের আশায় গাছে নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক স্প্রে করেন। কয়েক ধাপে সে সব কেমিকেল স্প্রে করা হয়ে থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কাচা লিচু পাকানো এবং আকর্ষণীয় রঙের জন্য রাইপেন জাতীয় মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। লিচু আকারে যাতে বড় হয় সেজন্য জোবাস, কোরজেন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। আবার লিচু যাতে ঝড়ে না পড়ে সেজন্য ভারতীয় সিনথেটিক পাইরয়েড ব্যবহার করা হয়। পোকামাকড় যাতে না ধরে সেজন্য ডেসিস, বেল্ট, রিপকট, ফ্লোরা, জিকোজিন ব্যবহার করা হয়।
লিচু বিক্রির জন্য হাটে এনেছে চাষিরা (ছবি : দৈনিক অধিকার)
এসব রাসায়নিক ক্ষতিকর লিচু চাষি বা ব্যবসায়ীরা তা ভাল করেই জানেন। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনেক চাষি নিজেদের পরিবারের লোকদের খাওয়ার জন্য আলাদা গাছ রাখছেন। রাসায়নিক বিষ ছাড়া সেসব গাছের লিচু নিজেরা খান। এসব লিচু গাছের নাম দেওয়া হয়েছে ‘খাওয়ার গাছের লিচু।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট পাবনা আঞ্চলিক অফিসের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, নিয়ম অনুযায়ী লিচু বাজারজাতকরণের অন্তত ২০ দিন আগে গাছে কোনো কেমিকেল স্প্রে করা যাবে না। এটা করা হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বাগান মালিকরা লিচু বাজারজাত করার আগের দিনও গাছে কেমিকেল স্প্রে করে থাকেন এমন অভিযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এটি মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আকসাদ আল মাসুর আনন জানান, লিচুতে অতিমাত্রায় কেমিকেল স্প্রে করা হলে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তিনি বলেন, কীটনাশক ব্যবহার করা হলে পয়জনিং হতে পারে। এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বড়দের জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়। কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা লিভার সিরোসিস হতে পারে। লিচুর বাগানে যে হরমোন স্প্রে করা হয় এর প্রভাবে আমাদের শরীরের ভাইটাল অর্গান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ওডি/এএসএল
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড