• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লক্ষ্মীপুরে লিগ্যাল এইডে আস্থা বাড়ছে বিচারপ্রার্থী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর

  রাকিব হোসেন আপ্র, লক্ষ্মীপুর

২৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:৩৩
লিগ্যাল এইড অফিস
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সহযোগিতা নিচ্ছেন স্থানীয়রা (ছবি- দৈনিকই অধিকার)

যৌতুকের টাকার জন্য স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের হাতে বারবার নির্যাতিত হয়েছি। একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘদিন যাবত তাদের অকথ্য ভাষার গালমন্দ ও শারীরিক নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেছি। অবশেষে লিগ্যাল এইড অফিসের সহযোগিতায় এ নির্যাতন থেকে আমি মুক্তি পাই। ভেঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় আমার সংসার। জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে দৈনিক অধিকার প্রতিনিধিকে কথা গুলো বলছিলেন লিগ্যাল এইডের সুফলভোগী লক্ষ্মীপুর পৌরসভার লিপি আক্তার (২৪)। তার স্বামী রাকিব হোসেন এক সময় প্রবাসী ছিলেন, এখন রঙ মিস্ত্রীর কাজ করেন। তাদের একমাত্র ছেলে ইব্রাহিম খলিল (৩)।

লিপি আক্তার বলেন, যৌতুকের টাকা না পেয়ে আমাকে গালমন্দ ও মারধরের বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে ডেকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। তবুও আমার ওপর নির্যাতন থেমে থাকেনি। এক পর্যায়ে আমার শিশু সন্তান ও আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য প্রতিবেশী আইনজীবী রিনা পারভীনের নিকট যাই। তার পরামর্শে লক্ষ্মীপুর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে মামলা করি। এরপর মাত্র ৪ মাসের মধ্যে আপোষ চুক্তিতে রাজি হয়ে যান আমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এতে আমি খুশি। কারণ আমি সংসার ভাঙতে চাই না। অবশেষে লিগ্যাল এইড অফিসের কারণেই দ্রুত সংসার ফিরে পাই আমি।

আইনজীবী রিনা পারভীন দৈনিক অধিকারকে বলেন, লিপি আক্তার আমার প্রতিবেশী এক হতদরিদ্র বাবার মেয়ে। যৌতুকের জন্য সে তার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। এ ঘটনায় সে আদালতে মামলা করার জন্য আমার নিকট পরামর্শ চায়। পরে আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম তার দরিদ্র বাবার পক্ষে আদালতে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তখন আমি তাকে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠাই। সেখানে সরকারি খরচে একটি মামলা দায়ের করে লিপি আক্তার। সেই মামলায় লিপির পক্ষে আমাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয় লিগ্যাল এইড অফিস। এক পর্যায়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থায় উভয় পক্ষকে আপোষ-মিমাংসা ও যৌতুকের কুফল সম্পর্কে বোঝানো হলে তারা এতে সম্মত হয়। এরপর বিকল্প পদ্ধতিতে আপোষ-মিমাংসার ব্যবস্থার মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। এখন তাদের সংসার ভালই চলছে।

একইভাবে রামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম হাসন্দী গ্রামের বাসিন্দা আপন দুই ভাইয়ের মধ্যেও সমঝোতা হয়। প্রায়ই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাদের পরিবারের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও মারামারি হতো। এক পর্যায়ে ছোট ভাই আহসান উল্লাহ তার বড় ভাই শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদন করেন। ঘটনার বিস্তারিত জানতে পেরে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা তাদেরকে আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা, ২০১৫ অনুসারে মিমাংসা নোটিশ পাঠান। পরে লিগ্যাল এইড অফিসে ডেকে তাদেরকে মামলার সামাজিক কুফল ও পারিবারিক সম্পর্ক অটুট রাখার গুরুত্ব বোঝানো হয়। এরপর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অকপটে দুঃখ প্রকাশ করেন। এক ভাই অন্য ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আপোষ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান তারা।

লিগ্যাল এইডঅফিসে আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে (ছবি- দৈনিক অধিকার)

জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে লক্ষ্মীপুর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রথম বারের মতো নিয়মিত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে প্রায় ৪২টি মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিকল্প পদ্ধতিতে আপোষ-মিমাংসা বৈঠক করেছেন জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ও সিনিয়র সহকারি জজ ফাহদ বিন আমিন চৌধুরী। যার মধ্যে ১১টি মামলা সম্পূর্ণরূপে নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১১টি মামলায় আইনজীবী নিয়োগ ও ১২টি আপোষ-মিমাংসা পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে একাধিক সুফলভোগীকে প্রায় ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিয়েছেন তিনি।

তাছাড়া গত এক বছরে ২৯৯টি মামলা হাতে নিয়েছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার মামলা দায়ের হয়েছে এই অফিসের মাধ্যমে। যার মধ্যে ১ হাজার ৮৬টি মামলা চলমান রয়েছে। লিগ্যাল এইডের তালিকাভুক্ত ৪৮ জন প্যানেল আইনজীবী এসব মামলা নিয়ে কাজ করছেন।

জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ফাহদ বিন আমিন চৌধুরী দৈনিক অধিকারকে বলেন, এখানে দরিদ্র ও অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের সরকারি খরচে আইনি সহায়তা প্রদান করা হয়। পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, মোহরানা-খোরপোশ আদায়, বিবাহ বিচ্ছেদ, দ্বিতীয় বিয়ে, প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধসহ ছোটখাটো অপরাধগুলো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় মীমাংসা করা হয়। তবে হত্যা-অপহরণ, হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণের মতো গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ এ ব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হয় না। কারণ মূল আইনে এসব মামলা আপোষযোগ্য নয়।

তিনি আরো বলেন, রাগ, ইগো, অজ্ঞতা, প্রতিহিংসা আর তৃতীয় পক্ষের কুমন্ত্রণার কারণে মানুষ ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক ফৌজদারী মামলায় জড়িয়ে পড়েন। অথচ এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনা মামলায় রূপ নেওয়ার আগেই লিগ্যাল এইডের আইনি ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের পূর্ণ সন্তুষ্টিতে কাঙ্খিত সমাধান করা সম্ভব।

লক্ষ্মীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি মো. শাহেনূর দৈনিক অধিকারকে বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং যেকোনো অবস্থা বা পরিস্থিতিতে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। তাই নাগরিকের এই আইনি অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে বর্তমান সরকার। এই সংস্থার মাধ্যমে নাগরিকদের সরকারি খরচে আইনি পরামর্শ, কাউন্সিলিং, তথ্য সহায়তা প্রদান, বিকল্প পদ্ধতিতে আপোষ-মিমাংসার ব্যবস্থা এবং আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। অসহায় ও দরিদ্র হলে এ ধরনের সেবা বাদী ও বিবাদী উভয়ই পেতে পারেন। লিগ্যাল এইডের মামলা গুলো দ্রæত নিষ্পত্তির জন্য কর্মরত বিচারকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে বলেও জানান তিনি।

আগামীকাল ২৮ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় শেখ হাসিনার অবদান, বিনামূল্যে লিগ্যাল এইডে আইনি সেবাদান’।

ওডি/এসএ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড