• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মাত্র ২৮ বছর বয়সে যিনি লড়াই করেছেন ৪টি মারাত্মক ক্যান্সারের সঙ্গে

  ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম

১৭ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৪৮
লরেন এর্ডম্যান মার্লার
লরেন এর্ডম্যান মার্লার (ছবি : ইন্টারনেট)

কল্পনা করুন, মাত্র ২৮ বছর বয়সে ৪টি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া কারও কথা। আবার কল্পনা করুন, কারও শরীরে ভয়াবহ ও বিরল রোগের লক্ষণ রয়েছে, যা সারাজীবন তার শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বহন করে নিয়ে বেড়াবে। যার অন্যান্য ব্যক্তির চেয়ে ১৬ গুণের অধিক ক্যান্সার ঝুঁকি থাকবে! ভাবা যায় কী?

লরেন এর্ডম্যান মার্লারের জীবনের গল্প ঠিক এরকমই। যেখানে অপ্রতিরোধ্য শক্তি, অসীম সাহসীকতা ও পরিবারের সার্বক্ষণিক সহায়তায় মাত্র ২৮ বছর বয়সে ভয়াবহ ৪ ধরনের ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফেরেন লরেন মার্লার।

লরেনের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন তিনি অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ বুঝতে পারেন। সেই বয়সে কোনো না কোনো উপায়ে তিনি জানতে পারেন লক্ষণগুলো ছিল ক্যান্সারের।

টেক্সাসের মিডল্যান্ডে নিজস্ব গবেষণায়, কিশোরী লরেন বুঝতে পেরেছিলেন তার ধারণাই সঠিক। শুরু হল লরেনের একের পর এক দুঃসাহসিক ক্যান্সার থেকে বাঁচার আন্দোলন। যখন চিকিৎসক জানালেন, লরেনের ভাগ্য খুবই খারাপ তখন লরেন শুরু করলেন তার জীবনের গল্প বলা।

২০০৫ সালের কথা। একদিন লরেন পায়খানার সাথে রক্ত আসতে দেখলেন। তিনি ভীত হলেও লজ্জায় কাউকে বলারও সাহস পেলেন না। এভাবে নীরবে দু’বছর এ যাতনা সহ্য করে গেলেন। কিন্তু এক সময় লক্ষণগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে।

লক্ষণগুলো যখন মারাত্মক আকার ধারণ করছিল তখনও তিনি কাউকে বলতে চাননি। এখনও অনেক স্তন ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার বা এ জাতীয় ক্যান্সারের কথা ঘনিষ্ঠ কাউকে এমনকী আপন স্বামীকেও বলতে লজ্জা পান। লরেনও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।

লরেন বলেন, ‘‘আমি আমার লক্ষণগুলো দেখছিলাম এবং আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কোলন ক্যান্সার হয়েছে।” লক্ষণ মারাত্মক আকার ধারণ করলে লরেন একদিন মায়ের কাছে একটি চিঠি লেখেন। কারণ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলা তার কাছে সম্ভবপর ছিল না।

চিঠি পড়ে মা লরি এর্ডম্যানের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মা ভাবতেন লরেন ক্যান্সারের নাটক করছে। এমন কী চিকিৎসক তার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে বলে জানান। এজন্য তাকে অধিক আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

অধিক আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার পরও লক্ষণ না কমলে চিকিৎসক তাকে এন্ডোস্কোপি এবং কোলোনোস্কোপি করার পরামর্শ দেন। এই পরীক্ষার পর, লরেনের শরীরে পুরোপুরি মারাত্মক কোলন ক্যান্সার ধরা পরে। লরেন ঘুম থেকে উঠে মাকে এমন অবস্থায় দেখতে পান যেন তার মা ভূত দেখছে। সেদিন যে চিকিৎসক পরীক্ষা করেছিলেন তিনি কেঁদেই ফেলেছিলেন। চিকিৎসক তার জীবনে এমন লক্ষণ পূর্বে কখনই দেখেননি।

লরেনকে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এমডি এন্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারে’ পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসক মিগুয়েল রড্রিগেজ-বিগাস এর সরণাপন্ন হন। সেখানে লরেনের সমগ্র কোলন ও রেকটাম বা পায়ুপথের বেশকিছু অংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলা হয়। শুধুমাত্র ততটুকই রাখা হয় যতটুক না হলে তার বিপাক ক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করবে না।

মাত্র ৯ মাস পর সেই ক্যান্সার পুনরায় দেখা দিল। মায়ের মুখে চিকিৎসকের পরীক্ষার ফলাফল শোনার পর বিশ্বাসই হচ্ছিল না লরেনের। পরে আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। পাশাপাশি তিন মাসের কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন দেওয়া হয়। লরেনের বিশ্বাস ছিল তার ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ এখানেই শেষ হচ্ছে।

পাঁচ বছর অতিবাহিত হতেই জানা গেল লরেনের আশা ও বিশ্বাস সত্য হয়নি। লরেনের বয়স যখন ২৩ বছর, তখন পুনরায় তার শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পেল। পরীক্ষায় দেখা যায়, তার জরায়ুতে অস্বাভাবিক কিছু বোঝা যাচ্ছে। তখন চিকিৎসক পলিপের বায়োপসি দ্বারা এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার শনাক্ত করেন। জরায়ুর এই ক্যান্সারটিও ছিল খুবই মারাত্মক।

lauren1

বারবার ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেন হাসিমুখে

তারা পুনরায় ‘এমডি এন্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারে’ যান। সেখানে হিস্টেরেকটমি বা জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে সময় ক্যান্সার কোষ শুধুমাত্র পলিপেই ছিল। তাই জরায়ু কাটার প্রয়োজন পড়েনি। পাশাপাশি দিতে হয়নি কোনো কেমোথেরাপি।

চিকিৎসক রড্রিগেজ-বিগাস জেনেটিক পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পরীক্ষায় লরেনের জন্য আরেকটি খারাপ সংবাদ আসে। লরেন তখন একটি বিরল ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। যাকে CMMRD (Constitutional mismatch repair deficiency) বলা হয়। এই সমস্যা যাদের থাকে, তাদের কোষগুলো পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়।

তার পিতা-মাতা উভয়েই লিঞ্চ সিনড্রোমে (Lynch syndrome) আক্রান্ত ছিলেন। এতে PMS2 নামক এক ধরনের জিনের মিউটেশন ঘটে। যার ফলে এই জীনধারী ও পরবর্তীতে সন্তানের মাঝে এই জীন স্থানান্তরিত হলে, সন্তানও কোলন, এন্ডোমেট্রিয়ালসহ নানা ধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। যা স্বাভাবিকের চেয়েও ১৬ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ!

লরেন এমন দু’ধরনের জিন বহন করছেন। ফলে এটাই প্রমাণিত হয় তিনি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন। আরও হতাশার কথা হচ্ছে, এ ধরনের সমস্যার কোনো চিকিৎসা নেই। তবে শুধু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এছাড়াও যেকোনো ধরনের ক্যান্সারের শুরুতেই সনাক্তকরণ করার জন্য নিয়মিত স্ক্যান করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ জন লোকের এই সমস্যা রয়েছে যার মধ্যে লরেন হচ্ছেন একজন।

তিন বছর পর লরেন সর্দি, জ্বর ও প্রচুর ব্যথার সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। তাকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এবার স্ক্যান করার পর লিম্ফনোড বা লসিকাগ্রন্থিতে ক্যান্সার সনাক্ত হয়। এবারের চিকিৎসা আরো কঠিন হবে বলে জানান চিকিৎসকরা। শুধু তাই নয়, এই চিকিৎসা এতটাই হতাশাজনক হবে যে, নিঃস্ব হওয়ার সময় রোগী চিকিৎসকদের ঘৃণা করতে থাকবেন।

লসিকাগ্রন্থির ক্যান্সার চিকিৎসায় ছয়বার কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে একটি স্পাইনাল কর্ড বা স্নায়ুরজ্জুর ভেতর দিয়ে দেওয়া হয়। তাকে এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর ৬ দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হত। লরেন দুর্বল হয়ে বিছানা থেকে নামতে পারতেন না। তার সব চুল হারায় এবং শরীরে প্রচুর ব্যথা অনুভব করেন।

lauren

স্বামীর সঙ্গে লরেন

বর্তমানে লরেনের বয়স ২৮ বছর। লরেন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ২০১৭ সালে কেটি মার্লারের সাথে দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হন তিনি। কেটি জেনে শুনেই লরেনকে বিয়ে করেন। তবে লরেন এখনও সুস্থতার পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। তিনি তার এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে পাশে থাকার জন্য জন্য তার পরিবারকে ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি সবসময় হাসির উপায় খুঁজি। পরবর্তীতে কী ঘটবে তা নিয়ে কখনই চিন্তিত হই না।”

সারাবিশ্বের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের প্রতি লরেনের কিছু উপদেশ রয়েছে। বিশেষ করে যারা অল্প বয়সী এবং রোগ প্রকাশে লজ্জা পান তাদের প্রতি লরেন বলেন- “কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ প্রকাশ পেলে পরিচিত কাউকে বলতে হবে। বলতে না পারলে চিঠি লিখতে হবে। যা আমি নিজে করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “যদি আমি আমার এই অবস্থা জানাতে আর কিছুদিন সময় নিতাম তবে, আমায় ২০ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করতে হতো।”

অথচ চারটি মারাত্মক ক্যান্সার থেকে সুস্থ হয়ে লরেন আজ বিজয়ের হাসি হাসছে।

মূল লেখক : জেন বাবাখান।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড