নিশীতা মিতু
গ্রিক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে আগমন ঘটেছে ক্যালিগ্রাফি শব্দটির। ক্যালি বলতে বোঝানো হয় ‘সুন্দর’ আর গ্রাফিয়া বলতে ‘লেখা’। সে অর্থে ক্যালিগ্রাফি বলতে হরফ বা অক্ষর ব্যবহার করে যে সুন্দর লেখন শিল্প প্রকাশ করা হয়, তাকে বোঝানো হয়। ক্যালিগ্রাফি পছন্দ করেন না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে অত সুন্দর করে লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।
আমাদের আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষই বোধহয় ক্যালিগ্রাফির জাদুতে মুগ্ধ করেছেন চারপাশের মানুষকে। এমনই একজন মুনতাসির। যার পুরো নাম মুনতাসির হক মুন। তার অসাধারণ কাজ নিয়েই কিছুটা সময় আড্ডা হয় তার সঙ্গে।
কুরআনে হাফেজ মুনতাসির বর্তমানে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি শখ ও পেশা হিসেবে করে যাচ্ছেন ক্যালিগ্রাফি।
কবে থেকে মাথায় ক্যালিগ্রাফির চিন্তা এলো, শুরুটা কেমন করে, কীভাবে শখ থেকে পেশা হলো এটি?— জানতে চাই মুনের কাছে। তিনি জানান, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে শখ কিংবা ভাবনা শুরু হয়। তখন কলম পেন্সিল দিয়ে নিজে নিজেই লিখতেন।
মুন বলেন, ‘আমি নিজে নিজেই এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম যখন সুযোগ পেতাম। কেউ বললে তার নাম নিজের ডিজাইন মতো ক্যালিগ্রাফি করে দিতাম। সবাই বলত মাশাআল্লাহ! সুন্দর। চালিয়ে যাও। বাহবা পেতাম। কাগজে আর্ট করে দিতাম যে যে চাইত। এটা আমার একটা শখ বটে।
একদিন ছোট ভাই বলল যে, তুই একটা পেজ খুলতে পারিস। তাহলে ভালো হবে। কারও ইচ্ছে হলে তোর কাজ ভালো লাগলে তোর থেকে নিতে পারবে। বিনিময়ে তুই মূল্যও নিতে পারবি।
আমিও ভাবলাম ব্যাপারটা মন্দ নয়। কারণ পরিবারের আর্থিক সমস্যাও ছিল। নিজের খরচ নিজে চালানোর পাশাপাশি মায়ের খরচও দিতে হতো। এভাবেই শখ থেকে পেশা বা কাজ হিসেবে ক্যালিগ্রাফি করা।
কাজ করতে এসে ভালো খারাপ অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মানুষ। এমন কোনো স্মৃতি রয়েছে কি না জানতে চাইলে মুন বলেন, ‘এই কাজে এসে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প জমা হয়েছে জীবন খাতায়। এই যেমন, একদিন এক আপু রাত সাড়ে এগারোটায় ম্যাসেজ দিয়ে বললেন উনার একটা ক্যালিগ্রাফি চাই আয়তুল কুরসির। আমি ১০ দিন সময় চাইলাম। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। একদিনের মধ্যেই চাই উনার। আমি বললাম, এটা সম্ভব নয়। উনি জানালেন বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে উনার অর্ধাঙ্গকে ক্যালিগ্রাফিটা উপহার দেবেন।
ভাবলাম যেভাবেই হোক আমাকে কাজটা করতে হবে আর একদিনের মধ্যেই উনাকে পৌঁছে দিতে হবে। সারা রাত জেগে কাজ করলাম। ভাবলাম, পাঠাও এর মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি পাঠিয়ে দিব। বিকাল পর্যন্ত চেষ্টা করেও সেটা পাচ্ছিলাম না। আমিও নাছোড়বান্দা! রাতে টিউশন করে তারপর এক বন্ধুর সহযোগিতায় রাত ৯টার দিক উনার বাসায় গিয়ে দিয়ে ক্যালিগ্রাফি পৌঁছে দিয়েছি। উনি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন। এই খুশিই আমার তৃপ্তি। এমন আরও কিছু ঘটনা আছে। অন্যের খুশিতে নিজে তৃপ্ত হই। অন্যকে খুশি করাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’
ক্যালিগ্রাফির প্রতি নিজের আগ্রহের কথা বলতে গিয়ে মুনতাসির জানান, আরবি লেখা বা আর্ট দেখতে ভালো লাগত। আর সেই ভালোলাগা থেকেই ক্যালিগ্রাফি করার ইচ্ছা মনে জাগ্রত হয়। শুরুর দিকের চলার পথ অবশ্য খুব একটা মসৃণ ছিল না। পরিবারের বাধা না থাকলেও মূল বাধা ছিল আর্থিক সমস্যা।
কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই মুনতাসির বলেন, ‘এই আর্ট বা ক্যালিগ্রাফিকে সবাই মূল্যায়ন করে না। মানুষের মন বা তার কার্যবিধির ওপরই এসব নির্ভর করে। দেখা যায় অনেকে এই আর্ট থেকে ভিন্ন কিছুর আর্টের বেশি প্রশংসা করে। আবার ইসলামিকমনা বা যারা আর্ট বুঝেন বা ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা এটাকে মূল্যায়ন করে ভালোভাবে।
ক্যালিগ্রাফি অনেক কষ্টের কাজ। সেই সঙ্গে অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই কেউ যখন ‘এত দাম কেন?’ প্রশ্ন করে তখন কিছুটা কষ্ট লাগে, আবার বিব্রতও হই। আসলে আমাদের দেশে ক্যালিগ্রাফির পরিব্যাপ্তি কম। তবে ধীরে ধীরে সেটা বাড়ছে, এটা ভালো দিক।
নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি জানান, ভালো লাগার প্রাপ্তিগুলোকে বড় করে দেখেন। কাজ করার সময়, সবসময় মাথায় রাখেন কীভাবে নিজের কাজের মাধ্যমে কাস্টমার বা ক্লায়েন্টকে খুশি করতে পারবেন।
কেবল কাজ করেই দায়িত্ব শেষ করেন না মুনতাসির। ঢাকার অভ্যন্তরে কোনো কাজের অর্ডার থাকলে নিজে গিয়েই ক্লায়েন্টের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন নিজের চিত্রকর্ম। নিজ থেকে পৌঁছে দেওয়ার মাঝেই খুঁজে পান তৃপ্তি।
সম্প্রতি পেন্সিল থেকে আয়োজিত এক এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেন মুনতাসির, যেখানে তার ৪টি ক্যালিগ্রাফি ছিল। এর প্রত্যেকটিই ছিল ভিন্ন এবং ধারণাগুলোও ছিল ভিন্ন। ক্যালিগ্রাফিগুলো সবার অনেক প্রশংসা কুড়ায় এবং সবগুলোই বিক্রি হয়।
নিজের কাজগুলো নিয়ে মুনতাসিরের একটি ফেসবুক রয়েছে যার নাম ‘মুন ক্যালিগ্রাফি’। এখানে তার করা ক্যালিগ্রাফিগুলো পাওয়া যাবে। নিজের কাজ কিংবা পেশা নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা বা আশা ‘মুন ক্যালিগ্রাফি’ একদিন বড় একটি প্রতিষ্ঠান হবে। স্বপ্ন অনেক বড়, তার চেয়ে বড় হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকা।
বর্তমানে আরবি ফ্রন্ট নিয়ে কাজ করলেও শিগগিরই বাংলা আর ইংলিশ ক্যালিগ্রাফি নিয়েও কাজ করব। ইচ্ছে হচ্ছে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।’
ক্যালিগ্রাফির জাদুতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাক মুনতাসির। তার কাজের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ুক দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
‘মুন ক্যালিগ্রাফি’র ফেসবুক পেজের লিঙ্ক : Moon Calligraphy
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড