মনিরুল ইসলাম মনি
পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প ছাড়াই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় পলিথিনের ব্যাগ। ২০০২ সালে হঠাৎ নিষিদ্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। সরকারি বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও মানুষ পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি নিত্য প্রয়োজনীয় এই উপকরণটি। এই শূন্যতা অনুভব করেই পলিব্যাগের বিকল্প আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি রসায়নবিদ ও পরমাণুবিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান। তার আবিষ্কার পলিব্যাগের বিকল্প পাটের তৈরি ব্যাগ ইতোমধ্যেই পেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ব্যাগের নাম দিয়েছেন ‘সোনালি ব্যাগ’।
সোনালি ব্যাগ বাংলাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়ে পরমাণুবিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান বলেন, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের পাটপণ্যের প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বাংলাদেশে প্রচুর পাট উৎপাদন হয়। কাঁচামাল খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমাদের উদ্যোক্তারা যদি এ শিল্পে বিনিয়োগ করে তাহলে তারা লাভবান হবে, পাশাপাশি পরিবেশও রক্ষা হবে। তারা এগিয়ে আসলেই ঘুচে যাবে পাটের দৈন্য, ফিরে আসবে সোনালি আঁশের হারানো গৌরব।
রসায়ন আর পরমাণুবিজ্ঞানের সংকরায়ণে পাটের সেলুলোজ দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেন এই বিজ্ঞানী। জানালেন সোনালি ব্যাগ তৈরির খুঁটিনাটি। প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানী বলেন, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে প্রথমে আমি স্টার্চের কথা ভাবি। কিন্তু এটা মূলত পাওয়া যায় ভাত, ভাতের মাড় ও আলুতে। এই উপাদান থেকে পচনশীল পলিথিন বা প্লাস্টিক তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভেবে দেখলাম খাবার সংগ্রহ করা খুব কঠিন হবে। আবার পৃথিবীর অনেক দেশেই খাবার দিয়ে পণ্য উৎপাদন একেবারেই নিষিদ্ধ।
এই পাটবিজ্ঞানী বলেন, গরু কিন্তু ঘাস ও ভাত দুটোই হজম করতে পারে। এখানেও কিন্তু একটা রসায়ন কাজ করে। পাটে প্রচুর পরিমাণ সেলুলোজ আছে। তখন আমি চিন্তা করি পাটের সেলুলোজকে পলিস্যাকারাইড করার। আমার পিএইচডির এক ছাত্রকে নিয়ে কাজটি শুরু করি এবং অবশেষে আমরা সফলও হই।
ড. মোবারক বলেন, ২০১৬ সালে আমি প্রথম পাট থেকে ব্যাগ তৈরি করি। আর এই ব্যাগ পানিতে ক্ষতি হবে না কিন্তু মাটিতে পচে যাবে। আমার এই আবিষ্কার পছন্দ করে পাট মন্ত্রণালয়। আমি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তৎকালীন পাট প্রতিমন্ত্রীর অনুরোধে আমি পরের মাসেই বিজেএমসিতে বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করি।
সোনালী ব্যাগের আবিষ্কারক বলেন, বর্তমানে রাজধানী ঢাকার ডেমরাতে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পাট থেকে প্লাস্টিক শিট ও ব্যাগ উৎপাদন করা হচ্ছে।
পড়াশোনা রসায়নে, পরমাণুতেও তার অগাধ গবেষণা। পিএইচডি করেছেন কাঠের সাথে প্লাস্টিক মিশিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের ওপর। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে আমি যখন পিএইচডি করি। তখন আমার চিন্তা ছিল কাঠ ও প্লাস্টিক মিশিয়ে কিছু একটা তৈরি করার। যেটা টেকসই হবে। কিন্তু পরে ভাবলাম- বিষয়টা ব্যয়বহুল। আর পাট ও কাঠের রাসায়নিক বিষয় একই। পাটে ৭০ শতাংশ সেলুলোজ ও কাঠে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ সেলুলোজ রয়েছে।
পাটের সেলুলোজ দিয়ে তৈরি উপাদান সংরক্ষণ করে বহুবিদ ব্যবহারের জন্য গবেষণা চলছে বলেও জানান তিনি। এই বিজ্ঞানী বলেন, পাটের সেলুলোজ দিয়ে তৈরি উপাদান সংরক্ষণ করার জন্য গবেষণা চলছে। খুব শিগগিরই আমরা সফল হব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
পাট থেকে শুধু ব্যাগই নয়; তৈরি করা হয়েছে জুটিনও। যেটা ঢেউটিনের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। আর এই জুটিন স্টিল থেকেও ৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী। আর এই টিনও পরিবেশবান্ধব। এই টিনের ঘরে ঢুকলেই মনে হবে ঘরটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি)।
তিনি বলেন, আমার উদ্ভাবিত এই পণ্য বাজারজাত করার ব্যাপারে এ পর্যন্ত অনেকেই আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমি সবার কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। কিছু দিন আগে বাঁধন, সাইমুম, হাসানুল ও মেহেদী নামের চার তরুণ আমার কাছে এসেছিল। এই পণ্যের ব্যবসায়িক দিক নিয়ে কীভাবে তারা কাজ করতে চায়, সে দিকটি খুব যত্ন সহকারে বুঝিয়েছে। আমার খুব পছন্দ হলো ওদের পরিকল্পনাটা। ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম ওরা খুবই মেধাবী আর বিচক্ষণ। তাই ওদের আমার উদ্ভাবিত ‘পাট থেকে ঢেউটিন’ নিয়ে কাজ করার অনুমতি দিলাম নির্দ্বিধায়। ওদের প্রতি আমার আস্থার মর্যাদা ওরা রেখেছে। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার জিতে প্রমাণ করেছে ওরা আসলেই দক্ষ। আমার বিশ্বাস, ওদের মাধ্যমে এই পরিবেশবান্ধব পণ্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করবে।
আরও পড়ুন : নুর আর ভিপি হতে চান না
পাটের সেলুলোজে সোনালি ব্যাগ তৈরির পর তার পরবর্তী তিন আবিষ্কারের কথাও জানালেন মোবারক আহমদ খান। তিনি বলেন, আমার নতুন তিন আবিষ্কারও পাটের। একটি হচ্ছে সেলুলোজ ন্যানো ক্রিস্টাল (সিএনসি)। বিশেষ এই স্ফটিক বেশ দামি বলে গ্রাম হিসেবে বিক্রি হবে। এই উপাদান দিয়ে মানবদেহের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করা যাবে। তিন কেজি পাট থেকে এক কেজি সিএনসি তৈরি হবে। এটি ইস্পাতের চেয়েও ২২ গুণ বেশি শক্তিশালী।
ড. মোবারক বলেন, আমার দ্বিতীয় আবিষ্কার লিগনিন। যেটি ব্যবহার করা হবে ওষুধ ও প্রসাধনী শিল্পে। আর তৃতীয়টি হলো- সেলুলোজ ন্যানো ফাইবার (সিএনএফ)। এটিও ওষুধ শিল্পে ব্যবহার করা হবে।
পরিবেশবন্ধু এই বিজ্ঞানী প্রকৃতি সহায়ক আবিষ্কারে আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে চান। যাতে তার এসব আবিষ্কার বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সবখানে, সবার হাতে হাতে।
ওডি/এমআই/টিএএফ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড