প্রযুক্তি ডেস্ক
বাংলাদেশের ছোট অজো পাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা মর্তুজা আজম-ই আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে কর্মরত সিনিয়র সাইবার সিকিউরিটি অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ার। এই প্রতিষ্ঠানটির ওয়ার্ল্ড সদর দপ্তর শিকাগোর উইলিস টাওয়ারে (আমেরিকার একমাত্র ১১০ তলা টাওয়ার এটি) সাইবার সিকিউরিটির প্রায় সকল প্রযুক্তিকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে এসে অটোমেটিক্যালি নিয়ন্ত্রণ করার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
পৃথিবীতে সাইবার নিরাপত্তা যখন এক মহামারী হুমকির নাম, যার হাত থেকে আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনও নিরাপদ নয়। ঠিক তখনই বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার এস এম গোলাম মর্তুজা আজম কেবল ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সকেই নয়, ম্যানহাটান বোরো প্রেসিডেন্ট অফিস, আমেরিকার ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি তথা ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্ট জায়ান্ট এনবিসি ইউনিভার্সেলের মতো প্রতিষ্ঠানকে সাইবার সিকিউরিটি প্রদান করেছেন। তিনি আমেরিকাতে বসে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, এক্সেস টু ইনফরমেশন এর অ্যাডভাইজার, প্ল্যানিং মিনিস্টার প্রমুখ উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে কনফারেন্স ও মিটিং অব্যাহত রেখেছেন।
মর্তুজা আজম বরিশালের বানারীপাড়া ইউনিয়নের আলতা গ্রামের অরণ্য ঘেরা এক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িটিকে সিনেমায় দেখা কোনো এক ভূতের বাড়ি বললে হয়তো ভুল হবে না। নীরব বাড়িতে ৪ ভাই আর মা বাবাকে নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন। বাবা শিক্ষকতা করতেন আর মা সন্তানদের নিয়েই কর্ম জীবন পার করছিলেন।
১৯৯৬ সালের কোনো এক রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একদল নরপশু তাদের নীরব প্রশান্তির নীড়ে হামলা চালায়। মুহূর্তে রক্তের বন্যা বইতে শুরু করে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট শিশু মর্তুজা আজম সিঁড়ি বেয়ে দোতলা দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে পা পিছলে নিচে পড়ে যায়। নিচতলায় পড়ে যাওয়ার পর সে ফ্লোরে দাঁড়াতে পারছিল না, বারবার পড়ে যাচ্ছিল রক্তভেজা ফ্লোরে। মা বাবা আর ভাইয়ের রক্তে ভেজা ফ্লোরটিতে হামাগুঁড়ি দিয়ে সামনের দরজায় এসে দেখতে পায় বস্ত্রহীন বাবাকে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বাবাকে নর ঘাতকরা বিভিন্ন জায়গায় কোপাতে কোপাতে প্রায় মেরে ফেলে রেখে চলে যায়।
পরে প্রতিবেশীরা এসে বাবা, মা ও ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বানারীপাড়া থানা হাসপাতাল মর্তুজা আজমের বাবাকে ক্লিনিক্যালি ডেড দেখে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে প্রায় ৩ দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফিরে পান তিনি। বাবার মাথায়, ঘাড়ে, কোমরে, হাতে, পায়ে প্রায় ২৮ টিরও বেশি বড় ধরনের কোপ দেয়। দুই হাতের সকল আঙ্গুলগুলো চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দেওয়া হয়, যেন একজন শিক্ষক হয়েও আর কলম ধরতে না পারেন। এই কষ্ট শুধু মর্তুজার নয়, একটা পরিবারের।
শিশুদের অত্যন্ত প্রিয় একজন নিরীহ শিক্ষকের ওপর বর্বরোচিত এই হামলা পুরো জাতিকে লজ্জিত করে। নরপশুরা মর্তুজা আজমের শরীরের এক স্থানে, তার মায়ের দুই হাতে, মেজো ভাইয়ের মাথায়, নাকে ও চোখের ওপরে, কোমর ও পেটে কুপিয়ে জখম করে। দীর্ঘ কয়েক মাসের চিকিৎসার পর তার বাবা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে আসেন। তবে বাড়িতে নয়। ওই রাতের পর তাদের আর সেই স্থায়ী ঠিকানায় ফেরা হয়নি কোনোদিনই।
সন্ত্রাসীদের ক্রমাগত হুমকি আর জীবনের অনিশ্চয়তা কখনোই ফিরতে দেয়নি তাদের জন্মভূমি তথা বসতবাড়িতে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিই যখন মুমূর্ষু তখন তাদের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। জীবনের সাথে লড়াই করে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় তা মর্তুজা আজম এবং তার পরিবার খুব ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেন।
এমন দুর্দিনেও মর্তুজা আজমের মা ধৈর্য ধারণ করে ৪টি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। আজ যেন শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ৪টি সন্তান শুধু বাবা মায়ের কাছেই নয় সারা এলাকাবাসীর কাছেই ৪টি রত্ন। মর্তুজার বড় দুই ভাই দেশের পড়াশুনা শেষ করে আজ ইউরোপে সফল ব্যবসায়ী। সেজো ভাই একসময়ের স্বনামধন্য সাংবাদিক, আইনজীবী ও ইকোনোমিস্ট। আর বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা মেট্রোতে কর্মরত আছেন। মর্তুজা আজম ও তার পরিবার বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও আগ্রাসনের শিকার হন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ মর্তুজার ওপর গাজীপুরে জঙ্গিরা হামলা চালায়। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি ক্রমাগত হুমকির শিকার হন। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন ও কর্মজীবন শুরু করেন। মর্তুজা আজমের অল্প সময়ে এত বড় সাফল্যের পেছনে তার ঋণের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি যে কত মানুষের কাছে ঋণী তা বলে শেষ করতে পারব না। প্রথমত আমি পরম করুণাময় ও আমার মাতৃভূমির কাছে ঋণী, মা বাবা পরিবারের কাছে ঋণী, ছাত্রজীবনে যত খালা রান্না করেছেন তাদের কাছে ঋণী, শিক্ষকদের কাছে ঋণী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে ঋণী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরীর কাছে ঋণী এবং আমেরিকাতে এসে যত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি তাদের কাছে ঋণী।’
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মর্তুজা আজম ছিলেন মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকারী। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বিএসআইটি ও বাংলাদেশ পুলিশের ইনফরমেশন টেকনোলজির ট্রেনার ছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক ও সংবাদপাঠক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের আবৃত্তিকার ও ডকুমেন্টারির ভয়েস আর্টিস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাইবার ইন্টার্ন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশনের একজন সফল ইন্টার্ন ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অ্যাসেম্বলিতে ইয়াং লিডার হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন এবং প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটের সিনেটে বক্তব্যও রাখেন তিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে অর্জন করেন গ্র্যাজুয়েশন ও প্রোমাস্টারের স্বীকৃতি। বিভিন্ন ধরনের মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা, জাতিসংঘের গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স বেস্ট অ্যাওয়ার্ডসহ প্রায় ৭টিরও বেশি পুরস্কার ও ক্রেস্ট পান তিনি।
গোলাম মর্তুজা আজম সত্যিকারের জীবনসঙ্গী প্রাপ্তি এবং দুজন মিলে দেশ ও মানবতার সেবায় জীবনের বাকিটা সময় কাটানোর স্বপ্ন দেখছেন।
ওডি/এওয়াইআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড