মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির
পূর্ব প্রকাশের পর
আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হলেন। খলিফা হওয়ার পর সমবেত মুহাজির ও আনসারদের উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। ইসলামের প্রথম খলিফার প্রথম ভাষণ। তিনি বললেন,
‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলিফা বানানো হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি চাচ্ছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা যদি চান আমার আচরণ নবিজির আচরণের মত নিখুঁত হবে, তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবি। নিষ্পাপ, পবিত্র। তাঁর মত আমার বিশেষ কোন মর্যাদা নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবি আমি করতে পারি না। …আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, আমাকে সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, তাহলে সতর্ক করে দেবেন।’
নবিজির ওফাতের অল্প কিছুদিন আগে মুতা অভিযানে শাহাদাতপ্রাপ্ত যায়িদ ইবনু হারিসা, জাফর ইবন আবি তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নবিজি (সা.) একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। এ বাহিনীর কমাণ্ডার নিযুক্ত করেন নওজোয়ান উসামা ইবন যায়িদকে। নবিজির নির্দেশে উসামা তাঁর বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলেন। কিন্তু তারা মদিনা থেকে বের হতেই নবিজির অসুস্থতার সংবাদ শুনতে পান। তারা মদিনার উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করে নবিজির রোগমুক্তির প্রতীক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু এ রোগেই নবিজি (সা.) ইন্তেকাল করেন। আবু বকর (রা.) খলিফা হলেন। এদিকে নবিজির ওফাতের সংবাদে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দিকে নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কেউবা ইসলাম ত্যাগ করে, কেউবা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আবার কেউবা নবুওয়ত দাবি করে বসে। এমনি এক চরম অবস্থায় অনেকে পরামর্শ দিলেন উসামার বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে। কিন্তু আবু বকর (রা.) অত্যন্ত কঠোরভাবে এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যদি এ বাহিনী পাঠাতে বিলম্ব করেন তাহলে খেলাফতের দায়িত্ব লাভের পর এটা হতো নবিজির নির্দেশের প্রথম বিরুদ্ধাচরণ। কারণ, অন্তিম রোগশয্যায় তিনি উসামার বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আবু বকর (রা.) উসামার বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। তখন আনসারদের একটি দল দাবি করলেন, তাহলে অন্ততঃ উসামাকে কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে অন্য কোন বয়স্ক সাহাবিকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করা হোক। উল্লেখ্য যে, তখন উসামার বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর। সকলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি উমর (রা.) উপস্থাপন করলেন। প্রস্তাব শুনে আবু বকর (রা.) রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি উমরের দাড়ি মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যাকে নিয়োগ করেছেন আবু বকর তাকে অপসারণ করবে?’
হযরত উমরও ছিলেন এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত একজন সৈনিক। অথচ নতুন খলিফার জন্য তখন তার মদিনায় থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। খলিফা ইচ্ছা করলে তাঁকে নিজেই মদিনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি উসামার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে তার কাছে আবেদন জানালেন উমরকে মদিনায় রেখে যাওয়ার জন্য। উসামা খলিফার আবেদন মঞ্জুর করলেন। কারণ, আবু বকর বুঝেছিলেন উসামার নিয়োগকর্তা খোদ রাসুলুল্লাহ সা.। সুতরাং এ ক্ষেত্রে উসামার ক্ষমতা তাঁর ক্ষমতার ওপরে। এভাবে আবু বকর (রা.) নবিজির আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন এবং তাঁর সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ থেকেও বিরত থাকেন।
নবিজির ইন্তেকালের পর একদল লোক যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিষয়টি নিয়ে খলিফার দরবারে পরামর্শ হয়। সাহাবিদের অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু বকর (রা.) অটল। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! নবিজির যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো এখন যদি কেউ তা দিতে অস্বীকার করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো।’
কিছু লোক নবুওয়তের মিথ্যা দাবিদার ছিল। আবু বকর (রা.) অসীম সাহস ও দৃঢ়তা সহকারে এসব ভণ্ড নবির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। তাই ইতিহাসবিদরা মন্তব্য করেছেন, ‘আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তার পর যদি আবু বকরের এ দৃঢ়তা না হতো, মুসলিম জাতির ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।’
এমনটি সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, আবু বকরের স্বভাবে দু’টি পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, সীমাহীন দৃঢ়তা ও কোমলতা। এ কারণে তাঁর চরিত্রে সর্বদা একটা ভারসাম্য বিরাজমান ছিল। কোন ব্যক্তির স্বভাবে যদি এ দু’টি গুণের কেবল একটি বর্তমান থাকে এবং অন্যটি থাকে অনুপস্থিত, তখন তার চরিত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থাকে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে এ দু’টি গুণ তাঁর চরিত্রে সমানভাবে বিদ্যমান ছিল।
আবু বকর (রা.) যদিও মুসলমানদের বিশ্বনেতা ও খলিফা ছিলেন, তবুও তাঁর জীবন ছিল খুবই অনাড়ম্বর। খলিফা হওয়া সত্ত্বেও মদিনার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে জনগণের অবস্থা জানতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজও সময় সময় নিজ হাতে করে দিতেন। উমর (রা.) বলেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে এক বৃদ্ধার বাড়িতে তার ঘরের কাজ করে দিতাম। প্রতিদিনের মত একদিন তার বাড়িতে উপস্থিত হলে বৃদ্ধা বললেন, আজ কোন কাজ নেই। এক নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলি শেষ করে গেছে। উমর পরে জানতে পারেন, সেই নেককার লোকটি হলেন আবু বকর রা.। খলিফা হওয়া সত্ত্বেও এভাবে এক অনাথ বৃদ্ধার কাজ করে দিয়ে যেতেন।
আবু বকর (রা.) মাত্র আড়াই বছরের মত খেলাফত পরিচালনা করেন। তাঁর এ সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। নবিজির ইন্তেকালের পর তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। আরবের বিদ্রোহসমূহ নির্মূল করা। খেলাফত ও নেতৃত্বকে তিনি এত মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মুসলমানরা ইরান ও রোমের মত দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সাহসী হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বহু অঞ্চল দখল করে নেয়।
আবু বকরের আরেকটি অবদান পবিত্র কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণ। তাঁর খেলাফতের প্রথম অধ্যায়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেইসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েকশত হাফিযুল কুরআন শাহাদাত বরণ করেন। শুধুমাত্র মুসায়লামা কাযযাবের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতেই সাত শ’ হাফিয শহিদ হন। এরপর উমর ইবনুল খাত্তাবের পরামর্শে আবু বকর (রা.) সম্পূর্ণ কুরআন একস্থানে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন এবং কপিটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। ইতিহাসে কুরআনের এই আদি কপিটি ‘মাসহাফে সিদ্দিকি’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে উসমান ইবনু আফফানের যুগে কুরআনের যে কপিগুলি করা হয় তা মূলত ‘মাসহাফে সিদ্দিকি’র অনুলিপি মাত্র।
পবিত্র কুরআন ও রাসুলের বাণীতে আবু বকরের সীমাহীন মর্যাদা ও সম্মানের কথা বহুবার বহু স্থানে ঘোষিত হয়েছে। আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা যাহাবি ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। অত্যধিক সতর্কতার কারণে তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় খুব কম। উমর, উসমান, আবদুর রহমান ইবনু আউফ, ইবনু মাসউদ, ইবনু উমার, ইবনু আমর, ইবনু আব্বাস, হুযাইফা, যায়িদ ইবনু সাবিত, উকবা, মা’কাল, আনাস, আবু হুরাইরা, আবু উমামা, আবু বারযা, আবু মুসা, তাঁর দু’কন্যা আয়িশা ও আসমা প্রমুখ সাহাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। বিশিষ্ট তাবিয়িরাও তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন।
১৩ হিজরির ৭ জুমাদাল উখরা আবু বকর (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৫ দিন রোগাক্রান্ত থাকার পর হিজরি ১৩ সনের ২১ জামাদিউল উখরা মোতাবেক ৬৩৪ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে ইন্তেকাল করেন। নবিজির কবরের পাশে একটু পূব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড