মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির
কুরআনে নবী আলাইহিমুস সালামগণের দাওয়াতের একটা প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়। তাওহিদের পাশাপাশি তারা উম্মাহর মৌলিক সমস্যাবলির ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতেন। সাইয়িদুনা শুয়ায়িব এবং সাইয়িদুনা মুসা আলাইহিমাস সালামের দুটো প্রেক্ষাপট আমরা সামনে আনতে পারি।
শুয়ায়িব আলাইহিস সালামের সময়কালে শিরকের পরে তাঁর জাতির বড় সমস্যাগুলোর একটি ছিল মাপে কম দেয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন,
وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًاۗ قَالَ يَٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُۥۖ قَدْ جَآءَتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْۖ فَأَوْفُوا۟ ٱلْكَيْلَ وَٱلْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشْيَآءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَٰحِهَاۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
আর মাদইয়ানের (অধিবাসীদের) প্রতি তাদের ভাই শুয়ায়িবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো; তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। অতএব, তোমরা মাপ ও ওজন পুরোপুরি দিও এবং লোকদেরকে তাদের জিনিসপত্র কম দিও না। আর পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর সেখানে (আবার) অশান্তি সৃষ্টি করো না। এটাই তোমাদের জন্য ভালো, যদি তোমরা ইমানদার হও।” [কুরআন, ৭: ৮৫]
হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদের কী চমৎকার কম্বিনেশন! আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাত করে মাদইয়ানবাসী আল্লাহর হক নষ্ট করছিল, আর মাপে কম দিয়ে তারা বান্দার হক নষ্ট করছিল। এটা মাদইয়ানবাসীর মৌলিক একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর নবিদের কাজই ছিল উম্মাহর মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা। তাই শুয়ায়িব আলাইহিস সালাম এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। অবশ্য তাঁর জাতি তাঁর দাওয়াতের যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, তা আজকের সেক্যুলার সমাজ থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়।
قَالُوا۟ يَٰشُعَيْبُ أَصَلَوٰتُكَ تَأْمُرُكَ أَن نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ ءَابَآؤُنَآ أَوْ أَن نَّفْعَلَ فِىٓ أَمْوَٰلِنَا مَا نَشَٰٓؤُا۟ۖ إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلْحَلِيمُ ٱلرَّشِيدُ
তারা বলল, “হে শুয়ায়িব! তোমার সালাত কি তোমাকে এই আদেশ দেয় যে, আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদাত করত আমরা তাদের বর্জন করি? অথবা আমাদের ধন-সম্পদের ব্যাপারে আমরা যা করতে চাই তা করা ছেড়ে দেই? তুমি তো দেখছি খুব সহনশীল আর নীতিবান লোক!” [কুরআন, ১১: ৮৭]
ঠিক যেন আজকের সমাজের সেক্যুলারদের মতো—‘আরে ভাই, সবখানে ধর্ম টেনে আনবেন না তো!’ তারা না চাইছিল বাপ-দাদার মিথ্যে ধর্ম ছেড়ে তাওহিদের পথে আসতে; আর না চাইছিল, ধর্মকে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রবেশাধিকার দিতে। কিন্তু শুয়ায়িব আলাইহিস সালাম যেহেতু জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়েই আগমন করেছিলেন, তাই এই দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর সাইয়িদুনা মুসা আলাইহিস সালামের সময়ে বড় একটা সমস্যা ছিল, ফিরাউন বাহিনিকর্তৃক বনি ইসরাইলের উপর নিপীড়ন। তাই, মুসা আলাইহিস সালাম তাঁর দাওয়াতের মূল পয়েন্ট তাওহিদের পরপরই পীড়িত-দলিত বনি ইসরাইলের মুক্তির দাবি উঠিয়েছেন।
وَقَالَ مُوسَىٰ يَٰفِرْعَوْنُ إِنِّى رَسُولٌ مِّن رَّبِّ ٱلْعَٰلَمِينَ- حَقِيقٌ عَلَىٰٓ أَن لَّآ أَقُولَ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلْحَقَّۚ قَدْ جِئْتُكُم بِبَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَرْسِلْ مَعِىَ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ
মুসা বলেছিল, ‘হে ফেরাউন! আমি বিশ্বজগতের রবের পক্ষ থেকে একজন রাসূল। আমার জন্য সমীচীন নয়, আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলা। আমি তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি। অতএব, বনি ইসরাইলকে আমার সাথে যেতে দাও।’ [কুরআন, ৭: ১০৪-১০৫]
সাইয়িদুনা মুসা আলাইহিস সালাম যালিম ফিরাউনের বিপরীতে নিপীড়িত ইসরাইলিদের পক্ষাবলম্বন করলেন। তাদের মুক্তি চাইলেন। কারণ, একজন নবি উপস্থিত থাকতে কোনো জাতি যালিমের নির্যাতনে পিষ্ট হয়েই যাবে- এটা তো অসম্ভব। নবিদেরকে তো পাঠানোই হতো ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহান মিশন দিয়ে।
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولٌۖ فَإِذَا جَآءَ رَسُولُهُمْ قُضِىَ بَيْنَهُم بِٱلْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
‘প্রত্যেক জাতির জন্যই একজন রাসুল থাকে। যখন তাদের (সেই) রাসুল আগমন করেন, তখন তাদের মধ্যে সবকিছু ন্যায়ের সাথে নিষ্পন্ন হয়। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হয় না। [কুরআন, ১০:৪৭]
মোটকথা, নবি আলাইহিমুস সালামগণ শুধু তাত্ত্বিক তাওহিদের বুলি কপচান নি, বরং উম্মাহর সামগ্রিক সমস্যাবলি নিয়ে ভেবেছেন। কাজ করেছেন। বিশেষ করে, নিপীড়িত-নিগৃহীত মাযলুমানের মুক্তির জন্যে নিরন্তন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
উম্মাহর ইতিহাসে আমরা বরাবরই এর পূনরাবৃত্তি দেখতে পাই। এমনকি একটা কাফিরের উপরও যুলুম হওয়াকে ইসলাম সহ্য করে না। যুলম এবং যালিমের সাথে ইসলামের এই খুল্লাম খুল্লা অবস্থানের কারণেই যুগে যুগে পীড়িত-দলিত শ্রেণি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। আরবের নিগৃহীত দাসেরা কেন পঙ্গপালের মতো ছুটে এসেছিল ইসলামের দিকে? ইতিহাস পড়ুন, কেন আমাদের এতদাঞ্চলের দলিত হিন্দুশ্রেণি দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল? কারণ একটাই, তারা তাদের উপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা যুলুমের একটা স্থায়ী সমাধান পেয়েছিল।
তাই, নবিদের ওয়ারিশদের কর্তব্য হলো, নবিদের সেই ধারাকে রক্ষা করা। যেকোন যুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। হোক তা সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক। আসলে যুলুমের ব্যাপারটাই এমন যে, আপনি এক্ষেত্রে কখনোই নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে। যদি মাযলুমের পক্ষাবলম্বন না করেন, তাহলে যালিমের পক্ষ আর আপনাকে কষ্ট করে অবলম্বন করা লাগবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে যাবে। যালিমের যুলম চিরকাল থাকবে না, কিন্তু জাতি আপনাকে গাদ্দার হিসেবেই স্মরণ করবে।
ওয়ারাসাতুল আম্বিয়াগণ আজ নবিওয়ালা সেই কাজ ভুলে বসেছেন। সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। তাই অনিবার্যভাবেই তারা সমাজ থেকে নিগৃহীত হয়েছেন, হচ্ছেন। আর সমাজে দীন ও দুনিয়ার নতুন এক পার্থক্যরেখা সূচিত হয়েছে। কতিপয় আনুষ্ঠানিক ইবাদাতকেই দীন মনে করা হচ্ছে, আর জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে দীনের প্রবেশকে নিষিদ্ধ মনে করা হচ্ছে।গ্লোবালাইজেশানের এটা একটা অন্যতম মূলনীতি। সেক্যুলারিজমের মূলকথাও এটাই। ধর্ম থাকবে, তবে ব্যক্তিজীবনে। আনুষ্ঠানিকতায়। নৈতিকতা বা আধ্যাত্মিকতার একটা চর্চা হিসেবে। দেহ থাকবে, রুহ থাকবে না। আজকের সমাজে ধর্ম টিকে আছে চর্চিত এক উপজীব্য হিসেবে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ি আমাদের আলিমসমাজ। ওয়ারাসাতুল আম্বিয়াগণ। আর তারা তাদের দায়িত্ব থেকে যতটা হাত গুটিয়ে নেবেন, ততটাই সমাজ থেকে ধর্মের বিদেয় ঘটবে। নিজেরাও নিগৃহীত হবেন। ন্যায্য অধিকারের জন্য এক দুয়ার থেকে আরেক দুয়ারে দৌড়ে বেড়াবেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড