ধর্ম ডেস্ক
জিলহজের প্রথম দশকের ইবাদাত অনেক গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ। এ দশদিনে কিছু মৌলিক ইবাদতের সমন্বয় ঘটে। যেমন সালাত, সিয়াম, হজ, কুরবানি ইত্যাদি। এছাড়াও আমরা নফল সালাত, তাকবির পাঠ, জিকির, দান-সাদাকা ইত্যাদি বিভিন্ন ইবাদত করার চেষ্টা করতে পারি।
সালাত আদায় করা
মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রথম ধাপ হলো ফরজ ইবাদত। আর সালাতই হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। বিচারের দিনে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সালাত সম্পর্কে। তাই আমাদের ফরজ সালাতগুলো আদায় করতে হবে প্রথম ওয়াক্তে। কারণ প্রথম ওয়াক্তের সালাত মহান আল্লাহর পছন্দ। ফরজ সালাতগুলো যথাসময়ে সম্পাদন করার পাশাপাশি বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। তাহাজ্জুদ, চাশত, ইশরাক ইত্যাদি বিভিন্ন নফল সালাতগুলো আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। নফল সালাতের মাধ্যমেও আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “তুমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণ সিজদা করো (নফল সালাত আদায় করো), কারণ যখনই তুমি সিজদা কর, বিনিময়ে আল্লাহ্ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং গুনাহ মোচন করেন।” [সহিহ মুসলিম]
তবে এটি কেবল জিলহজ মাস নয় বরং অন্য সকল সময়ের জন্যও প্রযোজ্য।
সিয়াম পালন করা
সিয়াম পালন আল্লাহর নৈকট্য লাভের আরেকটি উত্তম ইবাদত। তাই এ দিনগুলোতে নফল সিয়াম পালন করা খুবই ফজিলতপূর্ণ। সিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য ঢাল স্বরূপ। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরাফার দিনের সিয়ামের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের সিয়ামের ব্যাপারে আমি ধারণা করি যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এটিকে বিগত ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।’ [সহিহ মুসলিম: ১১৬৩]
এ হাদিসের ভিত্তিতে যারা হজে যায়নি তাদের জন্য জিলহজের নয় তারিখ সিয়াম পালন করা সুন্নত। তবে যারা হজে গিয়েছেন, তাদের জন্য এদিন সিয়াম না রাখা উচিত। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আরাফার দিনে আরাফার ময়দানে সিয়াম রাখতে নিষেধ করেছেন। [সুনানে আবু দাউদ: ২৪৪২]
হজের দিন
এই দিনগুলির মধ্যে রয়েছে আরাফার দিন। আরাফার দিন হলো বড় হজের দিন। এটি ক্ষমা ও মাগফিরাতের দিন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নাজাতের দিন। যিলহজের এই দশকে যদি ফযিলতের আর কিছু না থাকত তবে এ দিবসটিই তার মর্যাদার জন্য যথেষ্ট হত। এ দিনের ফযিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফা দিবসই হজ।’ [তিরমিযি : ৮৯৩; নাসায়ি : ৩০১৬]
হজের দিন বা আরাফার দিন ইখলাস ও বিশ্বাসের সাথে এ কালিমাটি বেশি বেশি পড়া প্রয়োজন। রাসুল (সা.) আরাফার দিন এ কালিমাটি খুব বেশী পড়তেন—
لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ لَا شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلٰى كُلَّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু বিয়াদিহিল খাইরু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘আরাফার দিনে মহান আল্লাহ্ এতো অধিক সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোনদিন দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন এবং তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি জানো আমার এই বান্দারা আমার কাছে কী চায়? [সহিহ মুসলিম]
তাকবির পাঠ করা
এ দশ দিনের ইবাদতের মধ্যে তাকবির (আল্লাহু আকবর), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ উল্লেখযোগ্য।
যজিলহজ মাসের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষের জন্য উচ্চস্বরে, আর মহিলাদের জন্য নীরবে। একবারের অধিক পড়লেও সমস্যা নেই। ইমাম বুখারি (রহ.) বলেছেন, ইবনু উমর (রা.) এবং আবু হুরাইরা (রা.) এ দশদিন তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলতে বলতে বাজারে বের হতেন। মানুষরাও তাদের দেখে তাকবির বলতো। ইবনু উমর (রা.) মিনায় অবস্থানের দিনগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে তাঁবুতে, বিছানায়, বসার স্থানে, চলার পথে সর্বত্র তাকবির পাঠ করতেন।
মুসলমানদের উচিত এ সুন্নতটি পুনর্জীবিত করা, যা বর্তমান যুগে প্রায় হারিয়ে গেছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নেককার লোকেরাও এটি প্রায় ভুলতে বসেছে। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
তাকবির
‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লা-হিল হামদ।’
কুরবানির দিনের মর্যাদা
এই মহান দিনটির মর্যাদার ব্যাপারে অনেক মুসলমানই অসচেতন। কোনো কোনো আলিমের মতে কুরবানির দিনটি বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো কুরবানির দিন, এরপর স্থিরতার দিন।’ (অর্থাৎ কুরবানির পরবর্তী দিন। কারণ, সেদিন মানুষ কুরবানির দায়িত্ব পালন শেষ করে সুস্থির হয়।) [নাসায়ি: ১০৫১২; ইবনু খুযাইমা: ২৮৬৬]
এই দশদিনের অন্যতম আমল হলো কুরবানি। সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। কারও কারও মতে, ওয়াজিব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর নবিকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ﴾
‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।’ [সুরা আল-কাউসার: ২]
কুরবানির পশু জবাই ও গরিবদের মধ্যে এর মাংস বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। এর দ্বারা গরিবদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায় এবং তাদের কল্যাণ সাধিত হয়। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কুরবানির দিনে আদমসন্তান এমন কোন কাজ করতে পারে না, যা আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত করা তথা কুরবানি করার চেয়ে বেশি প্রিয়। কুরবানির পশুর শিং, পশম ও খুরসহ কিয়ামতের দিন (কুরবানিদাতার পাল্লায়) এসে হাজির হবে। আর কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট সম্মানের স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা প্রফুল্লচিত্তে কুরবানি করবে।’ [সুনানে তিরমিযি: ১৪৯৩]
নখ, চুল ও গোঁফ না কাটা
যারা কুরবানি করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন, তারা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে হাত পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত লোম কাটবেন না। কুরবানির পর পরিস্কার করবেন। এ কাজটি সুন্নাত। উম্মু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে, ‘যখন জিলহজের প্রথম দিনের সূচনা হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছে করে, সে যেন চুল-নখ ইত্যাদি না কাটে।’ [সুনানে নাসায়ি কুবরা: ৪৪৫৪, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩১৪৯]
দান-সাদাকা করা
এ দিনগুলোতে যে আমলগুলো বেশি বেশি দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো সাদাকা। দান বা সাদাকা মহান আল্লাহর ক্রোধকে নির্বাপিত করে। আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে সাদাকা দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
‘হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা হতে ব্যয় করো, সে দিন আসার পূর্বে, যে দিন থাকবে না কোনো বেচাকেনা, না কোনো বন্ধুত্ব আর না কোনো সুপারিশ। আর কাফিররাই যালিম।’ [সুরা আল-বাকারা, ২৫৪]
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দান-সাদাকা সম্পদকে কমায় না, ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হলে আল্লাহ তাকে উঁচু করেন।’ [সহিহ মুসলিম: ৬৭৫৭]
আমরা সামর্থ্যানুযায়ী বেশি বা অল্প কিছু দান করেও এ সময় মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতে পারি।
জিকির
অন্যান্য সময়ের চেয়ে আমরা এ সময়ে বেশি যিকির করতে পারি। ওযু ছাড়াও সর্বাবস্থায় (ওয়াশরুম ব্যতীত) এ সহজ পরিশ্রমবিহীন ইবাদাতটি করা যায়। হাঁটতে হাঁটতে, কাজ করতে করতে, বিশ্রাম নেওয়ার সময় বা জ্যামে বসে থেকেও আমরা আল্লাহর প্রিয় এ কাজটি করতে পারি।
ইস্তিগফার অন্য সময় আমরা যতটুকু তাওবা বা ইস্তিগফার করি এ দিনগুলিতে তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি তাওবা, ইস্তিগফার করার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হয়েও আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) প্রতিদিন সত্তরবারের বেশি ইস্তেগফার করতেন। সেখানে আমাদের মতো গুনাহগার বান্দাদের কত বেশি ইস্তেগফার করা উচিত?
আমাদের সবাইকে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা যেন জিলহজ মাসের ইবাদতগুলো করার তাওফিক দান করেন। অমূল্য দিনগুলোর বিশেষ উপহার আমলগুলো যেন আমাদের আমলনামায় জমা করতে পারি। আমরা সবাই যেন দয়ালু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার মাগফিরাত প্রাপ্ত হয়ে জান্নাতের পথে অগ্রসর হতে পারি।
লেখক : ইসমত কণক
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড