• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

যিলহজের প্রথম দশদিনের ফযিলত

  ধর্ম ডেস্ক

০৩ আগস্ট ২০১৯, ২০:০২
02
ছবিঃ প্রতীকি

আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লা যেভাবে মাসসমূহ সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে রমাদান মাসকে বাছাই করেছেন যেন এ মাসে তিনি তার বান্দাদের আরও বেশি পুরস্কার দিতে পারেন, সেই একই নিদর্শনস্বরূপ, তিনি যখন দিবস সৃষ্টি করলেন তখন সর্বোত্তম দিবস হিসেবে যিলহজের প্রথম দশ দিনকে বাছাই করলেন। ইবাদাতের এই মৌসুমটি অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। যেমন কাউকে ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দেয় এবং কারো সীমাবদ্ধতা অথবা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সুযোগের ক্ষতিপূরণ করে। কেউ হয়তো রমাদান কিংবা এর পরবর্তী সুযোগকে হারিয়েছে এবং এ জন্য অনুতাপ করছে। এখন এই ক্ষতিপূরণের একটা সুযোগ আছে। এ ধরনের প্রত্যেক বিশেষ উপলক্ষ্যগুলোর কিছু আমল থাকে যেগুলো পালনের মধ্য দিয়ে বান্দা আল্লাহর আরো নিকটবর্তী হয়। একইভাবে, প্রতিটি বিশেষ উপলক্ষ্যের কিছু বারাকাহ থাকে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লা যাকে ইচ্ছা করেন তাঁর সাহায্য ও অনুগ্রহ দান করেন। সবচেয়ে বেশি আনন্দিত ও সফল ঐ বান্দা, যিনি আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে এসব বিশেষ মাস, দিন ও সময়গুলোর প্রায় পুরোটাই ইবাদাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। আল্লাহর বারাকাহ তাকে ছুঁয়ে যায় এবং সে এটা জেনে আনন্দ অনুভব করে যে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিলাভ করেছে।

কোন দিনগুলো যিলহজের প্রথম দশদিনের অন্তর্ভুক্ত? যিলহজের প্রথম দশদিন হচ্ছে ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১২তম মাস যিলহজের প্রথম দশদিন। এই দিনগুলোতেই অধিকাংশ হজযাত্রী মক্কা অভিমুখে সফর করেন এবং তাদের হজের কার্যাবলি সম্পাদন করেন। তাদের যেমন বাড়তি সওয়াবের অধিকারী হবার একটি বিশেষ সুযোগ থাকে, তেমনি যারা হজে যেতে সক্ষম হয় নি তাদের জন্যও এই দিনগুলোতে অতিরিক্ত সওয়াব লাভের একটি বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছে।

এই দশদিনের তাৎপর্য কি?

১) আল্লাহ আযযা ওয়াজাল কুরআনে এই দিনগুলি উল্লেখের মাধ্যমে এগুলোকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ আযযা ওয়াজাল বলেন, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের জন্য (হজের পরকালীন সওয়াব এবং সেইসাথে কিছু দুনিয়াবি, যেমন বাণিজ্য লাভও) উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসাবে দান করেছেন ওর উপর (যবেহকালে) নির্ধারিত দিনগুলিতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে...।’ [সুরা হজ, ২২: ২৮] অধিকাংশ উলামা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এই ‘নির্ধারিত দিনগুলি’ হচ্ছে যিলহজের প্রথম দশদিন। এর কারণ হিসেবে ইবনু আব্বাসের এই উক্তিটি দেখানো হয়, ‘নির্ধারিত দিনগুলি হচ্ছে (যিলহজের) প্রথম দশদিন।’ [বুখারির বর্ণনানুযায়ী]

২) আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লা কুরআনে এই দিনগুলোর নামে শপথ করার মাধ্যমে এগুলোকে সম্মানিত করেছেন এবং যখন কোনোকিছুর নামে শপথ করা হয় তখন এর গুরুত্ব ও অসামান্য উপকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লা বলেন, ‘শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাতের।’ [সুরা আল-ফজর, ৮৯: ১-২] ইবনু আব্বাস, ইবনুল জুবায়ির, মুজাহিদ এবং প্রথম ও পরবর্তী যুগের অন্যান্যদের মতে, এর দ্বারা যিলহজের প্রথম দশদিন উদ্দেশ্য। ইবনু কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটাই হচ্ছে সঠিক মত।

৩) দিনসমূহের মাঝে এগুলো মহাসম্মানিত ও সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দিন। আহমাদ এবং আত-তাবারানি ইবনু উমারের উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে এমন কোনো দিন নেই যা এই দশদিনের চেয়ে বেশি মহিমান্বিত ও এমন কোনো আমল নেই যা এই দশদিনে কৃত আমলের চেয়ে বেশি প্রিয়। সুতরাং বেশি বেশি তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ করো।’ [আহমাদ, ৭/২২৪; আহমাদ শাকির একে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন।] ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, নাহরের দিন (যিলহজের দশম দিন) হজের সময় (পূর্বের হাদিসে যেমন বলা হয়েছে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামরাতের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘দিনসমূহের মাঝে এই দিনটিই (অর্থাৎ যিলহজের দশম দিন) সর্বশ্রেষ্ঠ।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার বলতে লাগলেন, ‘ও আল্লাহ! সাক্ষী থেকো (আমি তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি)।’ এরপর তিনি লোকদের থেকে বিদায় নিলেন। লোকেরা বললো, ‘এই দিনটিই হাজ্জাতুল বিদা।’ [বুখারি ২/৭৯৮] ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কি জানো আজকের দিনটি কি?’ লোকজন বললো, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলই এ ব্যাপারে অধিক জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এটি নিষিদ্ধ (পবিত্র) দিন। এবং তোমরা কি জানো এটি কোন শহর?’ তারা উত্তর দিলো, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই এব্যাপারে অধিক জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এটি নিষিদ্ধ (পবিত্র) শহর (মক্কা)। এবং তোমরা কি জানো এটা কোন মাস?’ লোকেরা উত্তর করলো, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই এব্যাপারে অধিক জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এটা নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাস।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বললেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মানকে একে অপরের জন্য পবিত্র করেছেন, যেভাবে তোমাদের এই শহরের এই মাসের এই দিনটিকে পবিত্র করেছেন।’

৪) এই দিনগুলোতে ইবাদাত করা জিহাদে যাবার চেয়েও উত্তম (যা কিনা আপনাদের সম্ভবপর ইবাদাতসমূহের চূড়া)। এমন কোনো আমল নেই যে ব্যাপারে জিহাদের চেয়ে অধিকসংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু এই দিনগুলোতে ইবাদাত করা জিহাদের চেয়েও উত্তম। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এই দিনগুলোতে ইবাদাতকারী ব্যক্তির থেকে কেবল ঐ ব্যক্তিই উত্তম হতে পারে, যে তার সমস্ত সম্পদ ও পরিবার পরিজনসহ জিহাদে যায়, সমস্ত সম্পদ হারায় এবং আর কখনোই ফিরে আসে না।’ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল এই দিনসমূহের (অর্থাৎ যিলহজেহর দশদিন) আমলের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ।’ সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, এমনকি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না?’ তিনি বললেন, ‘না এমনকি জিহাদও না, তবে যদি কোনো ব্যক্তি তার জান ও মাল নিয়ে (আল্লাহর রাহে) ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কোনোটিই আর ফিরে না আসে।’ [হাদিসটি মুসলিম ও নাসায়ি ব্যতীত সিহাহ সিত্তার অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।]

৫) সাহাবা ও তাবিয়িদের কিছুসংখ্যক, (অন্যান্যদের মধ্যে) সায়িদ ইবনু যুবায়ির থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন প্রথম দশদিনের আগমন ঘটতো তারা এতবেশি পরিমাণ ইবাদাত করতেন যে একপর্যায়ে তারা হাল ছেড়ে দিতেন যে, এর চেয়ে বেশি ইবাদাত করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়।

এই দিনগুলির এত বিশেষ হবার কারণ কি? ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যিলহজের প্রথম দশদিনের বিশেষত্ব লাভের বাহ্যত কারণ হচ্ছে, এই দিনগুলোতে আল্লাহর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে যেসব মৌলিক আমল করা হয়, অন্য কোনোদিনে এগুলোর সন্নিবেশ ঘটে না’ (অর্থাৎ সালাত, সাদাকাহ, সাওম ও হজ)।

এই দিনগুলো কি রমাদানের শেষ দশদিন অপেক্ষা উত্তম? অধিকাংশ উলামা যে মতটি গ্রহণ করেছেন, তা হচ্ছে এই দশদিন রমাদানের শেষ দশদিন অপেক্ষা উত্তম। রমাদানের শেষ দশদিনকে যে বিষয়টি মহিমান্বিত করেছে তা হলো ভাগ্যের রাত (লাইলাতুল কদর) যা এক হাজার মাসের সমান। নিচের হাদিসটি এ ব্যাপারে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে যে, ‘যিলহজের প্রথম দশদিন যদি কেউ প্রত্যেকদিন দিনে ইবাদাত করে ও রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করে, তবে সে ভাগ্যের রাতে (লাইলাতুল কদর) ইবাদাত করার সমান সওয়াব পাবে।’ আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যেদিনের আমল আল্লাহর কাছে যিলহজের দশদিনের আমল অপেক্ষা বেশি প্রিয়। এদিনের কোনো একদিন যদি কেউ সাওম পালন করে তবে তা একবছর সাওম রাখার সমান এবং যদি কেউ একরাত তাহাজ্জুদের সালাত (শেষরাতের সালাত) আদায় করে তবে তা লাইলাতুল কদরে সালাত আদায় করার সমান।’ [তিরমিযি, ইবনু মাজাহ, বায়হাকি]

লেখক : শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিল (ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র)

অনুবাদ, লার্ন ইউর দীন টীম

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড