ধর্ম ও জীবন ডেস্ক
মাতৃভাষার সাথে মানুষের জন্মগত ও স্বভাবগত চাহিদা রয়েছে। আর এ চাহিদার অমূল্যায়ন ইসলাম কস্মিনকালেও করেনি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং রাষ্ট্রীয় ভাষাও বাংলা। সুতরাং বাংলা ভাষাকে অমূল্যায়ন করা বা অবহেলা করা কখনো সমীচীন হবে না।
ইসলাম মাতৃভাষাকে মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করেছে। তাইতো দেখা যায় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগেযুগে পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে সুপথে পরিচালনা করার নিমিত্ত অসংখ্য নবী রাসূলকে আসমানী কিবাতসহ তাদের স্ব-জাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।
যেমন হযরত দাউদ (আ.) এর ‘যবূর’ ছিল, তাঁর সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ‘ইউনানীতে’। হযরত মূসা (আ.) এর ‘তাওরাত’ ছিল, তাঁর সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ‘ইবরানীতে’। হযরত ঈসা (আ.) এর ইনজীল ছিল, তাঁর স্ব-জাতির মাতৃভাষা ‘সুরইয়ানীতে’ এবং আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি অবতীর্ণ ‘কুরআন’ ছিল তাঁর স্ব-জাতির মাতৃভাষা ‘আরবিতে’।
এভাবেই আল্লাহর বিধি-বিধান মানব জাতির কাছে পৌঁছানোর সহজতম পথটি অনুসৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ ‘আমি সব রাসূলকেই তাঁদের স্ব-জাতির ভাষাভাষি করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (আমার বাণী) সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে পারেন।’ (সূরা ইবরাহীম : ৪)
এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যেহেতু সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছিলেন, সেহেতু বিশ্বের প্রতিটি জাতির নিকট আল্লাহর বিধি-বিধান সঠিকরূপে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক জাতির ভাষায় পৃথক পৃথক কুরআন অবতীর্ণ করা হলো না কেন?
তার প্রতি উত্তরে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন ধরনের অভিমত পেশ করেছেন। তন্মধ্যে বাংলা পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত তাফসীর বিশারদ মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফীর (রহ.) অভিমত পরিধাণযোগ্য।
তিনি বলেন-
“বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে শতশত ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এমতাবস্থায় সবাইকে হেদায়াত করার দুটি উপায় সম্ভবপর ছিল। প্রথমত, প্রত্যেক জাতির ভাষায় পৃথক-পৃথক কুরআন অবতীর্ণ হওয়া এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শিক্ষাও তদ্রুপ প্রত্যেক জাতির ভাষায় ভিন্ন-ভিন্ন হওয়া। আল্লাহর শক্তির সামনে এরূপ ব্যবস্থাপনা মোটেই কঠিন ছিল না; কিন্তু সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এক রাসূল এক গ্রন্থ এবং এক শরীয়ত প্রেরণ করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে হাজারো মতবিরোধ সত্ত্বেও ধর্মীয় চারিত্রিক ও সামাজিক ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের যে মহান লক্ষ্য অর্জন করার উদ্দেশ্য ছিল, এমতাবস্থায় তা অর্জিত হতো না।
এছাড়া প্রত্যেক জাতির ও প্রত্যেক দেশের কুরআন ও হাদীস ভিন্ন-ভিন্ন ভাষায় থাকলে কুরআন পরিবর্তনের অসংখ্য পথ খুলে যেত। কিন্তু কুরআন একটি সংরক্ষিত কালাম, যা বিজাতি এবং কুরআন অবিশ্বাসীরাও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করে। এ অলৌকিক বৈশিষ্ট্য খতম হয়ে যেত।
এছাড়া একই ধর্ম এবং একই গ্রন্থ সত্ত্বেও এর অনুসারীরা শতধাবিভক্ত হয়ে যেত এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের কোনো কেন্দ্রবিন্দুই অবশিষ্ট থাকতো না। এক আরবি ভাষায় কুরআন নাযিল হওয়া সত্ত্বেও এর ব্যাখ্যা তাফসীরের বৈধ সীমার মধ্যে মত-পার্থক্য দেখা দিয়েছে। অবৈধ পন্থায় যেসব মত বিরোধ হয়েছে, সেগুলোর তো ইয়ত্তা নেই।
এ থেকেই উপরিউক্ত বক্তব্যের সত্যতা সম্যক অনুমান করা যায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যারা কোনো না কোনো স্তরে কুরআনের বিধি-বিধান পালন করে, তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য বিদ্যমান রয়েছে।
মোট কথা রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত সমগ্র বিশ্বের জন্য ব্যাপক হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রত্যেক জাতির ভাষায় ভিন্ন-ভিন্ন কুরআনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর শিক্ষা ও হেদায়াতের পন্থাকে কোনো স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিও সঠিক ও নির্ভুল মনে করতে পারে না। তাই দ্বিতীয় পন্থাটিই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ রাসূলের ভাষাই কুরআনের ভাষা হবে।
নায়েবে রাসূল আলেমগণ প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক দেশে রাসূল (সা.) এর নির্দেশাবলী তাদের ভাষায় বোঝাবেন এবং প্রচার করবেন। আল্লাহ তা‘আলা এর জন্যে বিশ্বের ভাষাসমূহের মধ্য থেকে আরবি ভাষাকে নির্বাচন করেছেন। (মা‘আরেফুল কুরআন, প্রকাশনায় মদীনা মুনাওয়ারা- ৭১২ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে উদ্দেশ করে বলেন- “আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর আল্লাহভীরুদেরকে সুসংবাদ দেন এবং কলহ প্রিয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।” (সূরা মারইয়াম : ৯৭)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন, “আমি আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ করে।” (সূরা দুখান : ৫)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন, আমি এ কুরআনকে আরবি ভাষায় (অবতীর্ণ) করেছি, যাতে তোমরা বুঝো। (সূরা যুখরুফ : ৩)
চলবে...
লেখক : মুরাদ বিন আমজাদ, প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ মুসলিম উম্মা ফাউন্ডেশন।
ওডি/এনএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড