• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত

  ধর্ম ও জীবন ডেস্ক

২০ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:০৬
শবে বরাত
ছবি : প্রতীকী

শবে বরাত এর 'শব' একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ 'রাত্রি'। বরাত কোনো ভাষারই বিশুদ্ধ শব্দ নয়। আরবী 'বরাআত' শব্দের অপভ্রংশ বরাত। আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে ভারতবর্ষে শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী নামে মহা সমারহে ধর্মিয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আরবী ( براءة ) বরাআত সূরা তওবার অপর নাম যার অর্থ হল সম্পর্কছেদ, নিষ্কৃতি বা মুক্তি। আল কুরআনে শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বলে কোন শব্দ নেই। আছে লাই-লাতুল ক্বদর ও লাইলাতিন মুবারাকাতিন, শব্দগুচ্ছ। (সূরা কদর ৯৭:১ সূরা দুখান ৪৪:৩) এছাড়া সহীহয়াঈনের গ্রন্থদ্বয়ের কোথাও শবে বরাত বা নিছফে সাবান বলে কোন শব্দের উল্লেখ নেই।

আমাদের উপমহাদেশের কিছু তথাকথিত কিছু ধর্মান্ধ পন্ডিতবর্গ দেখা যারা মিডিয়ায় ও টিভি পর্দায় নিজেদের ব্যাবসা টিকানোর জন্য সূরা দুখানের (৪৪:৩) أن أنزلناه في ليلة مباركة আয়াতটির অপব্যাখ্যা করে বলে থাকে এটি হলো শবে-বরাত তথা কুরআন নাযিলের রাত।

কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ মুফাসসির ও মুহাদ্দিস ফকীহগণের মতে ليلةمباركة লাইলাতিন মুবারাকাতিন মানে ليلةالقدر লাইলাতুল কদর। শুধু তাই না এ কথাটি কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। কারণ আল-কুরআন প্রথম নাযিল হয়েছে রমজান মাসে (বাকারা ২:১৮৫)।

কোন সময় ليلةمباركة অর্থাৎ মুবারক রাতে (দুখান ৪৪:৩) সে মুবারক রাতটির নাম কি যে রাতে কুরআনুল করীম নাযিল হয়েছে। ليلةالقدر (সূরা কদর ১) সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো কুরআন প্রথম নাযিল হয়েছে রমজান মাসের শেষ দশকের যে কোনো এক বেজোড় রাত্রে। (বিস্তারিত দেখুন তাঃ ইবনে কাসীর ও তাফসীর মাআরেফুল কুরআন (৪৪/৩)আয়াতের তাফসীর ১২৩৫পৃষ দ্রষ্টব্য)

যারা এ রাতকে শবে বরাত বলে তারা আল কুরআনের অপব্যাখ্যাকারি। ইবনে কাসীর রহঃ বলেছেন- ومن قال :انھا ليلة النصف من شعبان كماروى عن عكرمة فقد ابعدالنطمة فإن نص القرآن في رمضان (٤/١٢٣

প্রচলিত শবে বরাতের সংক্ষিপ্ত বাস্তব চিত্র-

আমাদের উপমহাদেশের শবে-বরাতের নামে যা হয়ে থাকে যেমন, এ রাতটি সৌভাগ্য রজনী হিসেবেই পালিত হয়। এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়। ধারণা করা হয় যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রুযী বৃদ্ধি করা হয়, সারা বছরের হায়াত-মউতের ও ভাগ্যের রেজিস্টার লিখিত হয়। এ রাতে রুহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বমীদের রুহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে। এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে তারা সারা রাত মৃত স্বামীর রুহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন।

বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি, ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা হয়। অগনিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। আত্মীয়েরা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়। হালুয়া রুটির হিড়িক পড়ে যায় (যদিও উলামায়ে হকের প্রচেষ্টায় অনেক কমে গেছে )। যুবুকেরা পটকা ফাটিয়ে, আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে রাত কাটিয়ে দেয়।

যারা কখনো সালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে সলাত আদায়ে রত হয়। অথচ তারা বাকী বছর ধরে ফরজ পালন করে না তবে ঐ রাতে নফল আদায় করে! অথচ দেখা যায় রাতভর নফল আদায় করে ক্লান্ত হয়ে সবাই বাড়ী ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। একসময়ে ফজরের আজান হয়। কিন্তু এযুবকগুলো ফজরের ফরজ সলাত পড়ে না, মসজিদগুলো আশানুরূপ মুসল্লী না পেয়ে মাতম করতে থাকে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ খুঁজতে হলে দুর্বিন দিয়ে দেখা লাগে।

১৪ কোটি মুসলিমদের এই দরিদ্র দেশে এই রাতকে কেন্দ্র করে কত লক্ষ কোটি টাকা যে শুধুমাত্র আলোকসজ্জা নামে আগরবাতি মোমবাতি পুড়িয়ে শেষ করা হয়, তার হিসাব কজন রাখে? অন্যান্য খরচ না হয় বাদই দিলাম। সংক্ষিপ্ত এই হলো আমাদের দেশের শবে-বরাত নামের প্রচলিত ধর্মীয় পর্বের বাস্তব চিত্র।

নোট : উল্লিখিত বিষয়ে দীনের ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করবো। তার আগে আমাদের কিছু দ্বীনি বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিসপে সাবানের ফজীলত নিয়ে। তাদেরকে বলতে চাই, আমারা ليلة النصف من شعبان কেও এই রাত্রির ফজীলতকে অস্বীকার করি না। কারণ কিছু দুর্বল ও হাসান সহীহ আসার দ্বারা মুহাদ্দিসগণের নিকট রাতটির ফজীলত স্বীকৃত। তবে এই রাত্রে কোন নির্দিষ্ট ইজতেমায়ী ইবাদতেরপক্ষে নই কারণ হাদীস বিশারদগণ তা স্বীকার করেননি। (দেখুন, اقتضاء الصراط المستقيم ص:٣٠٢ /سلسلة الأحاديث الصحيحة ٢/١٣٨)

মুফতি তাকী উসমানী দামাত বঃ ও বলেছেন, ‘অবশ্য এ কথা ঠিক যে, এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদত বা ইবাদতের বিশেষ কোন পদ্ধতি নির্ধারিত নেই। যেমন কিছু লোক নিজের থেকে মনগড়া আবিষ্কার করে বলে, এই রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে অমুক অমুক সূরা এতবার পড়ে দুই রাকাত নফল সলাত আদায় করলে বিশেষ সওয়াব ও ফজীলত পাওয়া যাবে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; শরীআতের কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়।‘ (ইসলামী মাসসমূহ ৯৭)

বলা যায় দুচারটি ধর্মীয় আকীদার ভিত্তিতে এই রাতকে পালন করা হয়।

(১) ঐ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আগামী এক বছরের জন্য ভালো মন্দ তকদীর নির্ধারিত হয় এবং (২) এই রাত্রে কুরআন নাজিল হয়। এই কথার উত্তর আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি এসব ليلةالقدر এর সাথে সংশ্লিষ্ট। (৩) এই রাত্রে রুহগুলো ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। সম্ভবত এ বিশ্বাসটি করা হয়ে থাকে সূরা কদরের ৪ ও ৫-আয়াতের উপর ভিত্তি করে। যার অর্থ : সে রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।

এখানে সে রাত্রি বলতে সবে কদর কে বুঝানো হয়েছে যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। অত্র সূরায় 'রুহ' অবতীর্ণ হয় কথাটি থাকায় অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের রুহগুলো সব দুনিয়ায় নেমে আসে। অথচ এখানে রুহ শব্দটি একবচন। এখানে 'রুহ' বলতে জিবরাঈল আঃ কে বুঝানো হয়েছে যা আল-কুরআনের অন্য আঘাতের তাফসীর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় انه لتنزيل رب العالمين نزل به الروح الأمين।

আল-কুরআন জগতসমূহের রবের নিকট থেকে অবতীর্ণ। জিবরাঈল আঃ. তা নিয়ে অবতরণ করেছেন আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন। (সূরা ২৬/১৯২ - ১৯৫) একথাই বলেছেন হাফেজ ইবনে কাসীর রহঃ.। এর সাথে মৃত আত্মার দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনই সম্পর্ক নেই।

সর্বোপরি যখন মহিমান্বিত রাত 'শবে কদরে' মৃত রূহগুলো ফিরে আসে না সুতরাং 'শবে বরাতে' ফেরত আসার তো প্রশ্নই আসে না।

চলবে...

লেখক : মুরাদ বিন আমজাদ, প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ মুসলিম উম্মা ফাউন্ডেশন।

ওডি/এনএম

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড