• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মাদরাসার নামে ভিক্ষাবৃত্তি, কী বলে ইসলাম

  ধর্ম ও জীবন ডেস্ক

১৬ মার্চ ২০২০, ১৩:২০
ইসলাম
ছবি: প্রতীকী

টঙ্গী থেকে বাসে উঠলাম। উঠলেন আরেকজন পাঞ্জাবি-টুপি পরা লোকও। তার হাতে একটি রশিদ বই। একটি মাদরাসার জন্য দান কালেকশন করছেন। লোকটি বলছেন, ‘সম্মানিত যাত্রী ভাই ও বোনেরা! কত টাকা কত পয়সা কতভাবে খরচ হয়ে যায়...।’ একজন দশ টাকা দান করলেন। দানকারীর পিতা-মাতার জন্য দুয়া করতে করতে লোকটি সামনে এগিয়ে এলে এক যাত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি মাদরাসার শিক্ষক কি না। উত্তরে লোকটি বললেন তিনি মাদরাসার শিক্ষক নন, এমনকি তিনি মাদরাসায় লেখাপড়াও করেননি। তিনি নাকি মাদরাসার কালেক্টর (দান সংগ্রহকারী)। মাদরাসাটি কোথায় তা জানতে চাইলে বলেন ‘২৭’। যাত্রী বললেন সাতাইশে তো এ নামে কোনো মাদরাসা নেই। আপনি কীসের কালেকশন করছেন? জবাব দিতে না পেরে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়লেন।

চলার পথে প্রায়ই এমন দান সংগ্রহকারীর মুখোমুখি হতে হয় আমাদেরকে। সরলপ্রাণ অনেকে বিশ্বাস করে এদের দানও করেন। আর এদের দান করার কারণেই বেড়ে চলেছে এসব প্রতারকের সংখ্যা। এর বাইরে রয়েছে একটি ব্যবসায়ী ভিক্ষুক শ্রেণি। যারা ভিক্ষাবাণিজ্য চালান নির্লজ্জভাবে। চরম অলসতা ও কর্মবিমুখতার কারণে অভাবী এসব হতভাগ্য বিনাপুঁজির মাধ্যম হিসেবে নির্লজ্জভাবে বেছে নেয় ভিক্ষার পেশা। কৃত্রিমভাবে ভিক্ষুক সৃষ্টির বিষয়টিও প্রায়ই আসে মিডিয়ায়। বিকলাঙ্গ শিশু, প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে মাধ্যম বানিয়ে চালিয়ে যান ভিক্ষাবাণিজ্য। ধোঁকাবাজির মাধ্যমে আবার সিন্ডিকেট করে একশ্রেণির লোক একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। যেখানে ভিক্ষা করাটাও একটা চাকরি। একজন ভিক্ষুক সারাদিন ভিক্ষা করে যা উপার্জন করে সেটা দিয়ে দিতে হয় তার মালিককে।

ইসলামের লেবাস কিংবা অনুভূতিকে পুঁজি করে বিচিত্র কৌশলে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে এরা। অথচ ইসলামে ভিক্ষা কিংবা কারও কাছে হাত পাতা একটি ঘৃণ্য কাজ। পৃথিবীর ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামই ভিক্ষা কিংবা কারও কাছে হাত পাতার বিষয়ে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে। হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি হলো ক্ষত স্বরূপ; এর দ্বারা মানুষ মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করে’। (নাসাঈ ৫/৯৭)

তাইতো রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের কারও কাছে হাত না পাতার ব্যাপারে শপথ করিয়েছেন।

হযরত আউফ ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহর (সা.) দরবারে নয়জন, আটজন কিংবা সাতজন ছিলাম। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসুলের হাতে বায়াত গ্রহণ করবে না? অথচ আমরা মাত্রই আকাবায় বায়াত গ্রহণ করেছি। আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসুলের হাতে বায়াত গ্রহণ করবে না? আমরা তখন হাত বড়িয়ে দিয়ে বললাম- হে রাসুল! আমরা তো বায়াত গ্রহণ করেছি। এখন আবার কীসের বায়াত? তিনি বললেন, ‘এই মর্মে শপথ নাও, কেবল আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, আমিরের কথা মেনে চলবে। তারপর তিনি নিচু স্বরে একটি গোপন কথা বললেন- আর মানুষের কাছে কোনো কিছু চাইবে না।’ (সহিহ মুসলিম ২/৭২১)

অন্যদিকে অভাব ছাড়া যদি কেউ কারও কাছে হাত পাতে তাহলে ইসলাম একে নিষিদ্ধ করে এর জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাব ব্যতীত ভিক্ষা করল সে যেন জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করল। (মুসনাদে আহমাদ : ২৯/৫১)

কিছু লোক আছে যাদের সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের সম্পদ বাড়ানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাতে। রাসুলে কারিম (সা.) তাদের কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কারও কাছে ভিক্ষা চায় সে তো জাহান্নামের আগুন ভিক্ষা চায়। তার ইচ্ছা, সে চাইলে জাহান্নামের আগুন কম ভিক্ষা করতে পারে বেশিও ভিক্ষা করতে পারে। (ইবনে মাজা ১/৫৮৯) পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছুই না চাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা করবে ইসলামে তার জন্য শুভ সংবাদ। হযরত সাউবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এই মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে যে, সে অন্যের কাছে হাত পাতবে না আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারি গ্রহণ করব। (ইবনে মাজা : ১/৫৮৮ )

একান্ত অভাবে পড়েও কারও কাছে হাত না পেতে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ হাতে উপার্জন করা ইসলামের শিক্ষা। ইসলামই বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছে এই স্লোগান, ‘নবির শিক্ষা করো না ভিক্ষা’। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।’ (সহিহ বুখারি ২/৫৩৫)

মদিনায় হিজরতের পর হযরত আলী (রা.) তীব্র অভাবে পড়েন। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলেন না। তবু তিনি কারও কাছে হাত পাতলেন না। বরং হাত পাতা ত্যাগ করে শহরতলির দিকে কাজের সন্ধানে বের হয়ে যান। এক জায়গায় একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখে তিনি ভাবলেন হয়তো মেয়েটি মাটি ভিজাবে। ওই মেয়েটির কাছে গিয়ে তিনি একেকটি খেজুরের বিনিময়ে একক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দিলেন। পর্যায়ক্রমে ১৬ বালতি পানি ১৬টি খেজুরের বিনিময়ে উঠিয়ে দিলেন। এমনকি তার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। মেয়েটির কাছ থেকে ১৬টি খুরমা পারিশ্রমিক নিয়ে তিনি চলে এলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে। নবিজির কাছে সবিস্তারে ঘটনাটি বললেন। কারও কাছে হাত না পেতে কর্মের পথ অবলম্বন করায় নবিজি (সা.) এতটাই খুশি হলেন যে, হযরত আলীর (রা.) সঙ্গে খেজুর খেয়ে এ কাজটিকে স্বাগত জানালেন।

কারও কাছে হাত না পেতে উপার্জনের জন্য শ্রমে লিপ্ত থাকাকে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। হজরত কাব ইবনু উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নিকট দিয়ে গমন করলে সাহাবায়ে কেরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা দেখে বলতে লাগলেন, এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে থাকত! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন যদি লোকটি তার ছোট ছোট সন্তান অথবা তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উপার্জন কিংবা নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর পথেই রয়েছে। (হাইসামি ৪/৩২৫)

কেউ যদি অভাবের কারণেও সাহায্য চায় তবু ইসলাম তা অপছন্দ করেছে। কারও দ্বারস্থ না হয়ে কর্মের প্রতি তাকে উৎসাহিত করেছে। মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টায় ব্রতী হলে আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত করে দেবেন, আল্লাহর করুণার প্রাচুর্য দান করবেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) এর কাছে কিছু আনসার লোক সাহায্য চাইল, তিনি তাদের কিছু দান করলেন। তারা পুণরায় প্রার্থনা করলে নবিজি (সা.) তাদের দান করেন এবং তার সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় অতপর তিনি বলেন আমার নিকট গচ্ছিত আর কোনো সম্পদ নাই। যে ব্যক্তি অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকবে মহান আল্লাহ তাকে পবিত্র এবং অমুখাপেক্ষী করবেন। যে ব্যক্তি অভাবের কথা মানুষের কাছে প্রকাশ করবে তার অভাব দূর হবে না এবং যে ব্যক্তি তা আল্লাহর করছে নিবেদন করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। (সহিহ মুসলিম ২/৭২৯ )

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড