• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ঐতিহ্যের মাহফিলকে রাখতে হবে লৌকিকতামুক্ত

  মুনশি আমিনুল ইসলাম

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:১৪
ইসলাম
ছবি: প্রতীকী

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ওয়াজ-মাহফিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আবহমান কাল ধরে এর চর্চা করে আসছে বাঙালি মুসলিমসমাজ। তবে সাম্প্রতিক কালে বিষয়টি তার যে ধর্মীয় রূপ সেটি বিসর্জন দিয়ে জাগতিক বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে বিভাজন। ইসলামের নামে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যক্তি মতাদর্শিক নানা ফেরকা। যারা অনলাইন-অফলাইন সবখানেই চালাচ্ছে নেক সুরতে হাঙ্গামা।

আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে ওয়াজ-মাহফিলকে ঘিরে। বক্তাদের কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে অনেক মূর্খ লোকজনও তাদেরকে সবক শেখানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে! বড় কষ্ট লাগে, যখন দেখি একজন আলেম আরেকজন আলেমকে অশোভন ভাষা ও ইঙ্গিত করে টিপ্পনি কাটেন। সাধারণ মানুষকে দীনের নসিহত করার চাইতে তারা পরনিন্দার হাঁড়ি খুলে বসতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যে কারণে সচেতন সমাজ মনে করেন, মাহফিলগুলোর আয়োজক কমিটি লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইসলামের প্রচার-প্রসার নয়; বরং ভিন্ন কোন ফায়দা হাসিলের জন্যই ওয়াজের নামে বড় বড় শো অফ করে থাকেন।

ওয়াজ-মাহফিল আসলে কী? ওয়াজ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। যিনি ওয়াজ করেন, তাকে বলা হয় ওয়াইজ। এর বহুবচন হলো ওয়ায়েজিন। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। সাধারণত ওয়াজ সুরেলা কণ্ঠে উপমার মাধ্যমে আকর্ষণীয় উপায়ে গল্প-কাহিনির সমন্বয়ে পরিবেশন করা হয়। মূলত ওয়াজ হলো, মানুষের মধ্যে দীনি ইলম প্রচার ও মানুষকে ঈমান-আমলের প্রতি মনোযোগী করার অন্যতম একটি প্রাচীন পদ্ধতি।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ৭৭টি নামের একটি হলো ‘ওয়াজ’। প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) হৃদয়স্পর্শী ওয়াজের মাধ্যমে মানুষকে দীনের পথে আহবান করতেন। সেই সূত্রে নবিজির (সা.) উত্তরাধিকারী হিসেবে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো এই নবুওতি কাজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর তারাই সফলকাম।’ (সুরা আলে-ইমরান :১০৪)

মাহফিলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? ওয়াজ-মাহফিল ইসলামে নতুন কোনো সংযোজন নয়, বরং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের একটি সুপ্রাচীন মাধ্যম এটি। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আমাদের নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবি-রাসুল এই কাজ করে গেছেন। এই ওয়াজ-মাহফিলের দ্বারা পথহারা মানুষেরা যেমন সঠিক পথের সন্ধান পায়, তেমনি ত্রুটিপূর্ণ আমলওয়ালা মুসলমানেরাও পায় সাফল্যময় আমলি জিন্দেগি গড়ার পথনির্দেশ।

মাহফিল যদি হয় আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেয়ার মাধ্যম, তবে এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।’ (সুরা তাওবা :১২২) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারণ উপদেশ মুমিনদেরই উপকারে আসে।’ (সুরা যারিয়াত :৫৫) ‘আমি প্রত্যেক নবিকে (আ.) তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি তাদের সম্প্রদায়ের কাছে, যাতে তারা জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হন। (সুরা মারইয়াম :৯৭) এ প্রসঙ্গে রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।’ (সহিহ বুখারি :৩৪৬১) এও বলেছেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (বায়হাকি শরিফ :১৬১৪)

আয়োজক কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য ওয়াজ-মাহফিল যেন অপচয়ের ক্ষেত্র না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। ওয়াজের নামে ভিত্তিহীন কিচ্ছা-কাহিনী বলে মূল্যবান সময় যেন কেউ নষ্ট না করতে পারে সেজন্য ওয়ায়েজদের কাছে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করার দাবি রাখা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আপনি বলুন! যারা জ্ঞানী এবং যারা জ্ঞানী নয় তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা যুমার :৯) অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে, হিকমত ও উত্তম ওয়াজের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে তর্ক করুন উত্তম পদ্ধতিতে। নিশ্চয় আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশি জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন।’ (সুরা নাহল :১২৫)

অতীব লজ্জার ব্যাপার, এখনকার অধিকাংশ ওয়াজ-মাহফিল যেন উৎসব বৈ আর আর কিছুই নয়। মাহফিলগুলো যেন আজ টাকা অপচয়ের প্রতিযোগিতা মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৬৮ হাজার এই গ্রাম বাংলার এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে প্রতিবছরই ওয়াজ-মাহফিল হচ্ছে না। আমার জানা মতে, এমনও গ্রাম রয়েছে যেখানে বছরে দশ থেকে বারোটি পর্যন্ত ওয়াজ-মাহফিল হয়ে থাকে! এই যে এতো এতো টাকা খরচ করে শত শত মানুষ জমায়েত করা হয় মাহফিলে, তাদেরকে যদি দীনের কিছু নির্যাসই না দেয়া যায়, তাহলে কী লাভ এসবের?

আমরা মাহফিলের আয়োজন করি নেক আমলের জন্য; অথচ আমাদের কিছু ভুলের কারণে এই মাহফিলগুলো হয়ে ওঠছে গুনাহের উপলক্ষ। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে, ওয়াজ-মাহফিল যেন আড়ম্বরপূর্ণ ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে না হয়; মাহফিলগুলো যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও হেদায়াতের মাইলফলক। অপব্যয়ের বিরুদ্ধে সতর্ক করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার হক প্রদান করো, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল :২৬-২৭) ‘হে বনী আদম! তোমরা প্রত্যেক সালাতের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও। আর খাও এবং পান করো, অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ :৩১)

বক্তা কেমন হওয়া দরকার? যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে জ্ঞানী হয়, তার দ্বারাই আল্লাহর অজস্র নেয়ামত অনুধাবন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে আপনিতেই তার মাথা নুইয়ে আসে। আল্লাহকে সে বেশি ভালোবাসতে শেখে। সে কথাই কুরআন বলছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ (সুরা আল ফাতির :২৮) হাদিসে রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কুরআন পড়ো। তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। কুরআনের বিনিময়ে ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না।’ (মুসনাদে আহমদ :৩/৪২৮) অপর হাদিসে রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা কুরআন পড়ো এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করো। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে।’ (মুসনাদে আহমদ :৪/৪৩৭)

অতএব চুক্তি করে ওয়াজ করে এমন বক্তাকে মাহফিলে দাওয়াত না দেয়াই উচিত। মহান আল্লাহ বলেন- ‘অনুসরণ করো তাদের, যাঁরা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় কামনা করে না। তাঁরাই সুপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াসিন :২১) হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘যে ভাষার বাগ্মীতা অর্জন করে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোন ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল করবেন না।’ (মিশকাত :৪১০)

শেষ কথা ইদানিং মাহফিলে এই বক্তা ওই বক্তার কুৎসা রটানো, কাফের-মুনাফিক বলে ফতোয়া দেয়া, জনসাধারণকে ভুল বুঝিয়ে মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর মতো সাঙ্ঘাতিক ফেতনাও ছড়িয়ে থাকেন। যা মুসলিম উম্মাহর জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, মাহফিল মানেই লোক জমানো নয়; মাহফিল হচ্ছে বেহেশতের বাগান। তাই যেভাবেই হোক মাহফিলগুলোকে রাখতে হবে লৌকিকতামুক্ত।

প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যখ্যা, সমাজের কোন অমীমাংসিত বিষয়ে ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, কোরআনের আয়াতের তাৎপর্য কিংবা অন্য যেকোন ধর্মের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সর্বপরি মানব জীবনের সকল দিকে ধর্মের গুরুত্ব নিয়ে লিখুন আপনিও- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড