মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ [সুরা ফাতিহা, ৪]
আয়াতে إِيَّا (শুধুমাত্র, কেবলমাত্র) অব্যয়টি বাক্যটিকে অত্যন্ত মজবুত করছে। মূলত মক্কার মুশরিকদের সাথে মুমিনদের পার্থক্যটাই ছিল এখানে। মুশরিকরা আল্লাহর ইবাদত করতে নারাজ ছিল না, কিন্তু এককভাবে, কেবলমাত্র, শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতেই ছিল তাদের যত আপত্তি। তারা চাইতো আল্লাহর পাশাপাশি তাদের হাতেগড়া দেব-দেবীগুলোরও পূজা করতে। বিপরীতে মুমিনদের ঘোষণা ছিল ‘আমরা কেবলমাত্র, শুধুমাত্র, একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করি।’
এটাই হলো তাওহিদের মূলকথা। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ—তাওহিদের এই কালিমার হাকিকত। এই কালিমায় যেমন লা-ইলাহা (নেই কোনো মাবুদ) বলে পৃথিবীর তাবৎ ব্যক্তি ও শক্তিকে অস্বীকার (نفي) করা হচ্ছে, উপরোক্ত আয়াতে ইয়্যাকা (শুধুমাত্র আপনারই) বলে ঠিক একইভাবে অন্য সমস্ত বাতিল মাবুদদের অস্বীকার (نفي) করা হচ্ছে। আবার ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া) বলে যেমন একমাত্র আল্লাহকেই ইবাদতের উপযুক্ত হিসেবে স্বীকার (إثبات) করা হচ্ছে, তেমনি উপরোক্ত আয়াতে না’বুদু (তোমারই ইবাদত করি) বলে ইবাদতের উপযুক্ত হিসেবে একমাত্র আল্লাহকেই স্বীকার (إثبات) করা হচ্ছে। সুতরাং এ আয়াতে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর হাকিকত পূর্ণরূপে ফুটে ওঠেছে।
মূলত ইতোপূর্বে আলোচিত আয়াতগুলোতে আল্লাহর জাত ও সিফাতের আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের দলিল পেশ করা হয়েছে। এগুলোতে কাফিরদের তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। আল্লাহকে তাকবিনি (মহাজাগতিক) ব্যাপারে তারা ঠিকই রব মানতো। আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা, জীবনদাতা, মরণদাতা এইসব ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কুরআনে আল্লাহ বলছেন,
قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ والأَبْصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللّهُ فَقُلْ أَفَلاَ تَتَّقُونَ
তুমি জিজ্ঞেস করো, ‘কে রিজিক দান করেন তোমাদেরকে আসমান ও জমিন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন যাবতীয় কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা?’ তখন তারা বলে উঠবে, ‘অবশ্যই আল্লাহ!’ তখন তুমি বলো, ‘তারপরেও ভয় করছ না?’ [সুরা ইউনুস, ১০ : ৩১]
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন? তবে তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ।’ তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? [সুরা আনকাবুত, ২৯ : ৬১]
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন?’ তারা অবশ্যই বলবে, ‘এগুলো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ।’ [সুরা যুখরুফ, ৪৩ : ৯]
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ’। এরপরও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে? [সুরা যুখরুফ, ৪৩ : ৮৭]
এতসব স্বীকার করা সত্ত্বেও মুশরিকরা আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নিতে, তাঁর ইবাদত করতে অস্বীকার করতো। তারা বলতো,
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ - وَانطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَىٰ آلِهَتِكُمْ ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ
‘সে (মুহাম্মদ) কি বহু ইলাহের পরিবর্তে এক ইলাহের কর্তৃত্ব সাব্যস্ত করে দিয়েছে? এ তো এক বিস্ময়কর ব্যাপার!’ তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, ‘তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের ইলাহদের পূজায় দৃঢ় থাকো। নিশ্চয়ই এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।’ [সুরা সাদ, ৩৮ : ৬]
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে, তারা বলে যে, ‘আমরা তো তাদের ইবাদত এ জন্যেই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।’ নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করে দেবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। [সুরা যুমার, ৩৯ : ৩]
ইবাদত কী
‘ইবাদত’ (عبادة) একটি ব্যাপক শব্দ। আভিধানিক অর্থ হলো—চূড়ান্ত বিনয়, আনুগত্য ও বশ্যতা। পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, প্রকাশ্য কিংবা গোপনীয় এমনসব কথা ও কাজকে ইবাদত বলা হয়।
যেমন : তাসদিক (তাওহিদের আন্তরিক সত্যায়ন), শাহাদাহ (তাওহিদের মৌখিক স্বীকৃতি), তাকওয়া (আল্লাহভীতি), তাওয়াক্কুল (ভরসা), খুশু-খুযু (আল্লাহর সামনে বিনয়-নম্র হওয়া), রজা (আল্লাহর ক্ষমার আশা), খওফ (আল্লাহর শাস্তির ভয়), নযর (মানত), যবেহ (কুরবানি), দুয়া (আহ্বান), ইস্তিয়ানাহ (সাহায্য প্রার্থনা), ইস্তিগাসাহ (বিপদাপদে উদ্ধারের আকুতি), ইস্তিয়াযাহ (আশ্রয় চাওয়া), মুহাব্বাহ (ভালোবাসা), ইখলাস (একনিষ্ঠতা), তাওবাহ (প্রত্যাবর্তন) ইত্যাদি।
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তিনি বলেছেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ [সুরা যারিয়াত, ৫১ : ৫৬]
আমাদের আলোচ্য সুরা ফাতিহার উপরোক্ত আয়াতের পরের অংশে ইবাদতেরই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকার ‘ইস্তিয়ানাহ’র ব্যাপারটি আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হলো সাহায্য প্রার্থনা। শাব্দিকভাবে এর দ্বারা যেকোনো ধরনের সাহায্য প্রার্থনাকেই বোঝায়। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে এটি এমন ‘তাকবিনি ইয়ানাহ’ (গায়বি সাহায্য) প্রার্থনা অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা আল্লাহর আয়ত্বাধীন, কোনো বান্দা, ওলি, পির কারও এতে কোনো অংশ নেই। আপনি কাউকে আপনার বোঝাটি মাথায় তোলে দেয়ার জন্যে আহ্বান করলেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ বোঝাটি ওঠিয়ে দেয়ার সক্ষমতা লোকটিকে আল্লাহ দিয়েছেন। তাই এটি শিরক নয়। কিন্তু এই বোঝাটিই যদি আপনি কোনো মৃত ব্যক্তির কাছে গিয়ে ওঠিয়ে দিতে প্রার্থনা করেন এই ধারণায় যে, কবরস্থ লোকটির এই ক্ষমতা রয়েছে, তবে তা নিরেট শিরক হবে। কারণ এ ক্ষমতা কবরস্থ ব্যক্তির নেই। এমনিভাবে যেকোনো গায়বি সাহায্য, অলৌকিক কোনো ব্যাপারে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তবে তা শিরক হবে। সুরা ফাতিহায় ঘোষিত ‘তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি’ এ ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক হবে।
চলবে ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়ুন সুরা ফাতিহার তাফসির [পর্ব-০৩]
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড