আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
মালয়েশিয়া থেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশি রেমিট্যান্স হাউসগুলো। ইতিমধ্যে তারা দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সাথে বৈঠক করে দেশে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণের কৌশল ও পদ্ধতি তুলে ধরেছেন।
জুলাই/ডিসেম্বর ২০২২, ৬ মাসে মালয়েশিয়া থেকে ৫শ ৪৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার, সমপরিমাণ পাঁচ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা অর্থ দেশে প্রেরণ করেছে।
বিদায়ী বছরের নভেম্বর মাসের চেয়ে ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ৫ পার্সেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আশার আলো দেখছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত রেমিট্যান্স। চার বছর ধরেই টানা বাড়ছিল রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। ২০/২১ অর্থ বছরে রেকর্ড পরিমাণ আয় আসে বাংলাদেশে। তবে বর্তমানে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স আহরণে ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ অবস্থানে নেমে এসেছে যা গত ২০/২১ অর্থ বছরে গড়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম।
মালয়েশিয়া থেকে বৈধ পথে ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশে এসেছে ২ হাজার ২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু গত অর্থ বছরে সে আয় কমে যায়। কারণ হিসেবে অনানুষ্ঠানিক বা হুন্ডিতে অর্থ প্রেরণে প্রতি ডলারে ৫-৬ টাকা বেশি পাওয়ায় অর্থ প্রেরকরা সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে।
হুন্ডিতে অর্থ প্রেরণের জন্য অর্থ প্রেরণকারী কোন প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় না বরং হুন্ডি ব্যবসায়ী তাদের নিকট যায় এবং দেশে অর্থ প্রেরণ করে। আরেকটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে সেটি হলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের খরচের অর্থ সেখানে কর্মীদের বা করো নিকট থেকে নিয়ে দেশে প্রবাসীর পরিবারকে টাকা দেয় ফলে সে অর্থ বাংলাদেশে প্রবেশ করে না।
এতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। এসব বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ প্রবাহ চালু রাখলে রেমিট্যান্স প্রবাহ পজিটিভ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ করলে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান এবং প্রেরিত অর্থ তসরুপ হওয়ার ঝুঁকি না থাকায় সচেতন প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশে অর্থ প্রেরণের নিশ্চিত পথ ধরার প্রবণতা বেড়েছে বলে রেমিট্যান্স হাউজগুলো আশাবাদী যে এ প্রবণতা ধরে রাখা গেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। তাই তাদের পক্ষে প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৫% করা এবং ২.৫% প্রবাসীর নামে প্রভিডেন্ট ফান্ড করার প্রস্তাব করেছে।
তারা বলেছে প্রতিটি প্রবাসীর নিজস্ব ব্যাংক হিসাব নম্বরে অর্থ প্রেরণ বাধ্যতামূলক করতে। এজন্য যাদের ব্যাংক হিসাব নেই তারা বাংলাদেশি তিনটি রেমিট্যান্স হাউসে এসে ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
রেমিট্যান্স হাউসগুলোর পক্ষে ডলার বন্ড ১ কোটি থেকে বৃদ্ধি করে ৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছে ফলে প্রবাসীরা উৎসাহ পাবে।
এছাড়াও রেমিট্যান্স হাউসগুলো নিজস্ব প্রণোদনা দিচ্ছে। নানামুখী প্রচারণা চালাচ্ছে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে। তবে মালয়েশিয়ার দূর দূরান্তে থাকা প্রবাসীরা বলছেন দেশীয় রেমিট্যান্স হাউসগুলো তাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউসের চিফ অ্যাক্সিকিউটিভ অফিসার ও ডাইরেক্টর সুলতান আহমেদ বলেন, বর্তমানে ডলারের বিনিময় হারের ব্যাপক তারতম্যের কারণে আমরা গ্রাহকদেরকে উপযুক্ত বিনিময় রেট প্রদান করতে পারছিনা।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য মালয়েশিয়া থেকে অগ্রণী ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠালে সরকার ঘোষিত ২.৫ % বোনাস প্রদান করা হচ্ছে। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণে ১৩ দশমিক ৫ পার্সেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ানোর দিকেই জোর তৎপরতা চলছে এবং প্রবাসীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের মালিকানাধীন অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউস, ন্যাশনাল ব্যাংক রেমিট্যান্স হাউস এবং সিটি ব্যাংক রেমিট্যান্স হাউস দেশে অর্থ প্রেরণ করে।
এনবিএল রেমিট্যান্স হাউসের চিফ অ্যাক্সিকিউটিভ অফিসার মো. আলী হায়দার মর্তুজা বলেন, এই মুহূর্তে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ সহায়তা বাড়ানো হলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
প্লাসিড মানি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, রেমিট্যান্স খাতে যে বিপর্যয় সেটা কাটিয়ে উঠতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। তবে এই মুহূর্তে বৈধ চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ সহায়তা বাড়ানো উচিত। এর পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলছেন, প্রণোদনার চেয়েও বেশি টাকা পাওয়া যায় হুন্ডির মাধ্যমে। তিনি বলেন ভিসা বাণিজ্য অর্থাৎ বাংলাদেশি কর্মী নিয়েজনকারী ব্যক্তিরা মালয়েশিয়ায় থাকা কর্মীদের নিকট থেকে রিঙ্গিত নিয়ে বিনিময়ে প্রবাসীদের পরিবারকে সমপরিমাণ টাকা দেয়। আন্ডার ইন ভয়েসের (প্রকৃত মূল্য কম দেখানো) মতো অবৈধ পথ আবার চালু হয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক, শিক্ষার্থীদের ও ব্যবসায়ীদের বৈধ খরচের জন্য দেশ থেকে অর্থ আগমন সুযোগ দিলে বাংলাদেশিরা স্থানীয়ভাবে ডলার ক্রয় বন্ধ করে দিবে এতে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাবে বাংলাদেশ।
কিন্তু সে সুযোগ না থাকায় অবৈধ উপায় অবলম্বন করছে। অপর দিকে প্রবাসী আয় প্রবাসীর দেশে নিজস্ব ব্যাংক হিসাব নম্বরে প্রেরণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই ফলে যে কোনো উপায়ে অর্থ প্রেরণ করছে।
মালয়েশিয়া থেকে শুধু তিনটি দেশীয় রেমিট্যান্স হাউসের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করে না অন্যান্য এজেন্সি আছে সেগুলোর সাথেও হাইকমিশনের বৈঠক করলে আরও সুফল পাওয়া যাবে বলে তারা আশা করেন।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় রেমিট্যান্সের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডিসহ প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার পাশাপাশি প্রবাসীদের সচেতনতার ওপর সরকার জোর দিয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধ ও প্রবাসীদের সচেতন করতে বাংলাদেশ হাইকমিশন কাজ করছে।
আমাদের উদ্দেশ্য শুধু কর্মী নয় নানান পেশার বাংলাদেশি যারা আছেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। যেন সবাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারে।
মালয়েশিয়া প্রবাসীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আহ্বান জানান হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার।
প্রতিনিয়ত সেবার মান মূল্যায়ন করছি এবং প্রবাসী কল্যাণে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছি। ‘ইজি একসেস টু সার্ভিস অর্থাৎ প্রবাসীর সঙ্গে হাইকমিশনের সহজ যোগাযোগ ও সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হাইকমিশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট হাইকমিশন বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি এসব বাস্তবায়নে প্রবাসীদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি আশাবাদী যে প্রবাসীদের সহযোগিতায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে স্মার্ট পদক্ষেপ সুফল দিবে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড