• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে ছাত্রলীগ

সোহাগ-জাকির ও শোভন-রাব্বানী প্যানেলে দ্বন্দ্ব  

  আয়াজ উর রাহমান

১৫ মে ২০১৯, ১৫:৫৫
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক (ছবি : ফাইল ফটো)

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর সংগঠনটির পদপ্রাপ্তদের সঙ্গে পদবঞ্চিতদের সংঘর্ষের ঘটনায় ব্যাপক উত্তজেনা সৃষ্টি হয়েছে। পদবঞ্চিতরা বেশিরভাগই সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের প্যানেলের বলে জানা গেছে।

দীর্ঘ এক বছর ধরেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা নিয়ে মতবিরোধ চলছিল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের সঙ্গে বর্তমান সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর মধ্যে।

শোভন-রাব্বানী দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিল বলে কমিটি গঠনের দায়িত্বভার পরে সাবেক দুই নেতা সোহাগ ও জাকিরের উপর। সর্বোচ্চ মহলের চাপের মধ্যেই বিকল্প পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুতির দায়িত্ব পান ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

এতে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েন ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দু’বার ফেরত এসেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। তাদের জমা দেয়া কমিটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা তালিকার বিশাল ফারাক থাকায় ফেরত আসতে হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন তাদের। কিন্তু এককভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দিয়ে ফের তোপের মুখে পড়েন শোভন-রাব্বানী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পরামর্শে একটি বিকল্প কমিটি আগে থেকেই প্রস্তুত রাখেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বায়োডাটা জমা পড়া নেতাদের থেকেই এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে সাবেক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগেই (বুধবারের মধ্যে) শোভন-রাব্বানী সঠিক তালিকা জমা দিতে ব্যর্থ হলে বিকল্প এ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি সোহাগ-জাকির।

এদিকে সোমবার ছাত্রলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটি হঠাৎ করেই ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে ঘোষিত এই কমিটিতে স্থান পান নি সোহাগ-জাকিরের প্যানলের নেতাকর্মীরা। এতে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষোভের ঝড় উঠে পদবঞ্চিত হওয়া সোহাগ-জাকিরের প্যানলের কর্মীদের মধ্যে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঘোষিত ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে বিতর্কিত ও অবৈধ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা। একপর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাতে হামলা চালায় সদ্য পদপ্রাপ্তরা। এতে ছাত্রলীগের হল কমিটির সাবেক নেতাসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বিকালে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকে বিক্ষোভ করেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে যান পদবঞ্চিত এসব নেতাকর্মীরা। পদবঞ্চিত এসব নেতাকর্মীরা সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের অনুসারী বলে জানা গেছে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, এ সময় পদপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে কয়েকজন সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইনকে 'শিবির' আখ্যায়িত করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জাকিরের অনুসারীরা সংবাদ সম্মেলন রেখে দাঁড়িয়ে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। সংবাদ সম্মেলনের ব্যানার ছিঁড়ে ফেললে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। এতে নেতৃত্ব দেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরান। একপর্যায়ে চেয়ার ছোড়াছুড়ি শুরু হলে আহত হন অন্তত ১৫ জন নেতা-কর্মী।

হামলার ঘটনায় আহত নেতাকর্মীরা হলেন- রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, ছাত্রলীগের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক ও ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদার, গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাঈফ বাবু, ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক তানভীর ভুঁইয়া শাকিল, ডাকসুর সদস্য ও কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক ও রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি বিএম লিপি আক্তার হামলার শিকার হন। চেয়ারের আঘাতে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশার মাথা ফেটে যায়। পরে আহত অবস্থায় তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পদবঞ্চিত হওয়া গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাঈফ বাবু জানান, সোহাগ-জাকিরের প্যানেলের কেউ এই কমিটিতে পদ পায়নি। তিনি বলেন, অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে ‘মাইনাস’ করা হয়েছে। আবার এমনও আছে যারা মাঠে ছিল না; এখন দেখছি কমিটিতে বড় পদ পেয়েছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, শোভন-রাব্বানী স্বজনপ্রীতি করেছেন। মাদারিপুর জেলার অনেক নেতাকর্মী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের ভাইকে এ কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে।

এটা কোনও আদর্শ কমিটিতে হতে পারে না বলে মন্তব্য করে ছাত্রলীগের এই নেতা বলেন, আমরা এই কমিটি মানি না, আপার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে আমরা অনুরোধ জানাবো এই কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হোক।

এছাড়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অনুসারীরাই হামলা চালিয়েছেন। তাদের দাবি, ঘোষিত কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরানের নেতৃত্বেই এই হামলা হয়েছে। তবে হামলা করার কথা ইমরান অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত থাকলেও তিনি হামলায় অংশ নেননি। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।

হামলার শিকার ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক বিএম লিপি আক্তার বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে মূলত সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে। তাদের অনুসারী সদ্য পদপ্রাপ্ত যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান আল ইমরানের নেতৃত্বে একাত্তর হলের ফাহিম হাসান, অমর একুশে হলের অনু আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’

তবে এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিজয় একাত্তর হল সংসদের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ফাহিম হাসান ও অমর একুশে হলের অনুর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ না পাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই আগের কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের অনুসারী। ছাত্রলীগের গত সম্মেলন হতে দেরি হওয়ায় সোহাগ-জাকিরের প্রতি কিছু নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা সম্মেলন দেওয়ার দাবি করলে তাদের ওপর সোহাগ-জাকিরের অনুসারীরা তখন কয়েক দফা হামলা চালিয়েছিলেন।

গত কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান সেই সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন জাকির-সোহাগের বিলাসী জীবন, টাকার ভাগাভাগি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। এরপর এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এ ঘটনার পরপরই গোলাম রাব্বানী ও সায়েম খানেরা সোহাগ-জাকিরের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে সম্মেলন দেওয়ার দাবি জানান। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ ২৯তম সম্মেলন হয়। তবে সম্মেলনের প্রায় আড়াই মাস পর ছাত্রলীগ নতুন নেতৃত্ব পায়। শোভন-রাব্বানীর হাতে নেতৃত্ব তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে দৈনিক অধিকার থেকে ফোন করা হয় সাবেক ছাত্রলীগের দুই নেতা সোহাগ-জাকিরকে। সোহাগ ব্যস্ত আছেন এবং পরে কথা বলবেন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এরপর সোহাগকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। জাকিরের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

কমিটি নিয়ে চলমান এই উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পদবঞ্চিতদের উদ্দেশে বলেন, আজকে যারা কমিটিতে পদ পান নি তাদের প্রতি আমার একটাই আহ্বান, আপনারা শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি বুকে ধারণ করে রাজনীতি চালিয়ে যান। রাজনীতি একদিনের না এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অপ্রাপ্তিকে শক্তিতে রূপান্তর করে নতুন উদ্দ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে হতাশ হবার কোনো সুযোগ নেই। আরও বেশি বেশি কাজ করে যেতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আমাদের সবার প্রাণের সংগঠন, সুতরাং সংগঠনের ভাবমূর্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমি বিশ্বাস করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী কোন কর্মী সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করতে পারে না।

আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দৈনিক অধিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে বসে এসব বিষয়ের সমাধান করা হবে।

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড