একে আজাদ
দেখতে দেখতে বছর পেরিয়েছে খালেদা জিয়ার কারাবাসের। গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাজীবনের ৩৬৫ দিন পার করেছেন। সাবেক তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীর মুক্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দলের তৃণমূল নেতারা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে মনে করেন নেতারা। রাজধানীর থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশা প্রকাশ করার পাশাপাশি দলের হাইকমান্ডকে দায়ী করছেন।
স্বেচ্ছাসেবক দলের স্থানীয় এক নেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) দৈনিক অধিকারকে বলেন, আমরা মনে করি দলের হাই কমান্ড যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা আন্দোলনের ডাক দিতে পারেননি।
তিনি আরও বলেন, ঐক্যফ্রন্টের সাথে এক হয়ে কাজ করা ভুল হয়েছে। তারা আমাদের নেতাদের ব্রেন ওয়াশ করেছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যেভাবে বুঝিয়েছেন বিএনপির নেতারা সেভাবেই বুঝেছে। তিনি দাবি করেন, হাই কমান্ডের উচিত দলের কাউন্সিল ডেকে ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করা। নতুন নেতৃত্বের কাছে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া।
খালেদার মুক্তির জন্য হাইকমান্ডকে দায়ী করে বিএনপির ঢাকা দক্ষিণের এক নেতা বলেন, ‘আমাদের আসলে দুঃখের কথা বলার জায়গা নাইরে ভাই, যার হাত ধরি সেই পিছলাইয়া যায়, কারে বিশ্বাস করুম। নেত্রীরে ওরা জেলে রাইখাই মাইরা ফালাইতাছে আর নেতারা চোখ বন্ধ কইরা তা দেখতাছে। ওরা খালি ঘুমায় আর রাইত পোহাইলে অফিসে ডাইকা সাংবাদিকদের লগে কথা বলে, প্রেস ক্লাবের রুমের ভিতরে বক্তব্য দেয়। ওরা মাঠে নামে না। ওরা দল চালাইতে না পারলে পদত্যাগ করুক। বিদেশে চইলা যাক, ম্যাডামের কপালে যদি জেল থাকে থাকুক, কিন্তু আকাইম্মাগুলারে দেখবার চাই না।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দৈনিক অধিকারকে বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। আমরা মনে করি বিএনপির চেয়ার পারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সব মামলাই সাজানো। মূলত তাকে শাস্তি দেয়া ও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পাতানো মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া তিনি সব মামলাতেই জামিন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে ন। এরই মধ্যে আপনারা সাংবাদিকরা দেখেছেন, চেয়ারপারসন জামিন পাওয়ার পর তাকে শোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। তাতেই বুঝা যায়, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্যাতন করাই একটি মহলের উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ শনিবার ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সাজানো মিথ্যা মামলায় এক বছর পরিত্যক্ত নির্জন কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বয়স ৭৩ বছর। প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ অসুস্থ শরীর। একা চলতে পারেন না। আদালতে বা হাসপাতালে আনতে গেলে হুইল চেয়ারই ভরসা। তারপরও টেনে হিঁচড়ে জবরদস্তি করে আনা হচ্ছে শেখ হাসিনার নির্দেশিত ক্যাংগারু কোর্টে। গত বৃহস্পতিবার তাকে আদালত নামের কারাগারের আলো-বাতাসহীন ছোট্ট একটি রুমে এনে এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। তার অসুস্থতা দিনে দিনে বাড়লেও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। পুরোনো রোগগুলো বেড়ে গেছে।
তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালের সুবিধা ও ব্যক্তিগত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দ্বারা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকেও বঞ্চিত করেছে শেখ হাসিনা।
তার আর্থারাইটিসের ব্যথা, ফ্রোজেন শোল্ডার, হাত নড়াচড়া করতে পারেন না। তার এই রকম শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও অমানবিকভাবে কারাগারের ভিতরে স্থাপিত ছোট্ট অপরিসর কক্ষের ক্যাংগারু আদালতে ঘন ঘন হাজির করা হচ্ছে। মূলত বেগম জিয়াকে আদালতে হাজির করার নামে টানা হেঁচড়া করে নির্যাতন করা হচ্ছে।
খালেদার আইনজীবীরা বলছেন, কারামুক্ত হতে চারটি মামলায় জামিন পেতে হবে। এই অবৈধ সরকারের হাত যেহেতু আইনের হাতের চেয়ে লম্বা, তাই সব নির্ভর করছে মিডনাইট ইলেকশনের প্রধানমন্ত্রীর ওপর। মন্তব্য করেন রিজভী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন দৈনিক অধিকারকে বলেন, আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না, খালেদা জিয়ার কারাবাস। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করেই খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হয়েছে এবং তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। যে ধরনের মামলা তার বিরুদ্ধে রয়েছে এগুলো জামিন যোগ্য। কিন্তু একটি বিশেষ মহলের ইশারায় চেয়ারপারসনকে আটক করে রাখা হয়েছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী খালেদার মুক্তি বিষয়ে দৈনিক অধিকারকে বলেন, আসলে খালেদার মুক্তি না হওয়া দুঃখজনক। আমরা মনে করছি তার মুক্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের বিশ্বাস আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে খালেদার মুক্তি আরও আগেই হয়ে যেত। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করেই তার জামিন বা মুক্তিতে বাধা দেয়া হচ্ছে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে তবে কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন , এ নির্বাচনে একটা বিষয় প্রমাণ হয়েছে যে, একটি দলের জনপ্রিয়তাই যথেষ্ট নয়। সংগঠন ছাড়া সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে কেন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি নাই সেটার উত্তর খুঁজতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে।
শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটশন মিলনায়তনে এক প্রতিবাদ সভায় তিনি এ কথা জানান।
তিনি আরও বলেন, আমরা নির্বাচন করেছি, কিন্তু আন্দোলন করিনি। আমরা শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছি। আমরা সফল না। তৃণমূলের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারিনি। লজ্জায় মাথানত হয়ে যায়, যখন ভাবি- এক বছর হলো আমাদের নেত্রী জেলে আছেন।
উলেখ্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে আরও ৩৫টি মামলা রয়েছে।
এরমধ্যে দুর্নীতি, পরিবহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে দায়ের করা পৃথক ২১টি মামলা রয়েছে।
ইতোমধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে খালেদা জিয়া। ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক। বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়।
এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর ও অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া অর্থদণ্ডও দেয়া হয়। পরে খালেদা জিয়া ও অপর আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৩০ অক্টোবর রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের আদেশ দেন হাইকোর্ট।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের দণ্ড দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক।
বিশেষ জজ আদালত ৫-এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান গত বছরের ২৯ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে খালেদা জিয়াসহ অপর আসামিদের ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ নভেম্বর মাসে আপিল করেন খালেদা জিয়া। আপিলের শুনানি এখনও শুরু হয়নি।
এজেড
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড