আরিফ চৌধুরী শুভ
ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) জীবনে বেশিরভাগ যুদ্ধে জয়ী হলেও ওয়াটারলুতে পরাজিত হন শিক্ষিত ও দক্ষ সেনা সদস্যদের শত্রুপক্ষের আক্রমণে অকালে হারিয়ে। তারপরেই তাকে পরাজয়ের নামতা গুণতে হয় পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে। সিদ্ধান্ত পাল্টালেন বোনাপার্ট। ফরাসি বিপ্লবের সেই সময়কার যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে বিশ্বসামরাজ্যে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বোনাপার্ট সামনের দিনগুলোতে শিক্ষা-দিক্ষায় সমবৃদ্ধ ও উন্নত রণ-কৌশল সম্পন্ন একটি বিশেষ জাতির পরিকল্পনা করলেন। সেই উদ্দেশ্য থেকেই নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিব।'
যুদ্ধে পরাজিত নেপোলিয়ন বুঝেছিলেন তার দেশে শিক্ষিত জাতির কদর ও বিশ্ব নেতৃত্বে প্রয়োজনীয়তা। তাই শিক্ষাকে ফ্রি ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন তার প্রজাদের জন্য। কিন্তু আমরা? আমরা আমাদের শিক্ষাকে দিনকে দিন বাণিজ্যকরণ করছি। এতেই যেন আমাদের নিছক আনন্দ। কার সন্তান কত দামি স্কুলে কত বেশি বেতন দিয়ে পড়ছেন, সেসবও গর্বের বিষয় আজ। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে কি অধিকার রয়েছে সেটি যারা জানেন না, কেবল তারাই এই গর্ব করে তৃপ্তি পান।
কিন্তু আমার/আমাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে। রক্তাক্ত হতে হয়েছে। মার খেতে হয়েছে। গ্রেফতার হতে হয়েছে। পালিয়ে থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। উপবাস থাকতে হয়েছে রাতের পর রাত। বন্দুকের বুলেট সহপাঠী ও শিক্ষকদের শরীর ছেদে গেছে। নিজের রক্তের ওপর রাস্তায় পড়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। তবুও রাজপথ ছাড়িনি আমরা। আমাদের বিজয় হয়েছে। আমাদের মুখের স্লোগান পাল্টেছে। আমরা প্রতিবাদী মিছিল থেকেই আনন্দ মিছিল দিয়েছি। আমাদের সবার মুখে মুখে ততক্ষণে রটে গেল এই মুহূর্তে খবর এলো, ভ্যাটমুক্ত শিক্ষা হলো। আজ সেই খুশির দিন। টানা ৪ মাস রাজপথে উচ্চ শিক্ষা থেকে ভ্যাট তুলে নিতে অহিংস আন্দোলন করে ১৪ সেপ্টেম্বর সফল হল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থী যেমন তাৎক্ষণিক করের বোঝা থেকে রক্ষা পেল তেমনি পুরো জাতি পেল করহীন একটি উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে ১৪ সেপ্টেম্বর একটি বিশেষ দিন। করমুক্ত শিক্ষার দিন। ১৪ সেপ্টেম্বরকে ভ্যাটমুক্ত শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি। সেই সাথে সে দিনের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
শিক্ষা আমাদের স্বাধীনতার অধিকার, আমৃত্যু লড়ে যেতে হবে সেই অধিকার আদায়ে। বাংলাদেশে শিক্ষার অধিকার মানুষের সংবিধান স্বীকৃত জন্মগত অন্যতম মৌলিক অধিকার। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষার বহুমুখী বাণিজ্যকরণ এবং অধিকার আদায়ে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার মানুষ ধরেই নিয়েছে শিক্ষার বাণিজ্যকরণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্ধ বাড়িয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার (ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ) বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় প্রথমে ১০ শতাংশ এবং পরে তা কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে। সরকার ২০১০ সালে আরও একবার ৪.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদের মুখে তখনও ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
২০১৫ সালে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে সরকারের এমন অন্যায় সিদ্ধান্তের। শান্তিপূর্ণভাবে ৪ মাস রাজপথে আন্দোলন করে সরকারকে বাধ্য করে শিক্ষার ওপর অর্পিত মূসক তুলে নিতে। ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অর্পিত ভ্যাট তুলে নেয়। সে দিন থেকে উচ্চ শিক্ষা হলো করমুক্ত। সরকারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে শিক্ষার্থীদের বিজয় হলো। সৃষ্টি হলো দেশের ইতিহাসে শিক্ষা অধিকার আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ইতিহাস। তাই এই আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মর্যাদা রাখে।
শিক্ষার্থীদের ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই আন্দোলনের সূচনা হয় ২০১৫ সালের ১৪ মে একজন শিক্ষার্থীর একটি চিঠির মাধ্যমে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য সূত্র মর্মে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ হতে পারে এমনটা নিশ্চিত হয়ে ২০১৫ সালের ১৪ মে গণমাধ্যমে সেই চিঠিটি পাঠিয়েছিলাম আমি নিজেই। চিঠিটি গণমাধ্যমের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষায় কর নিয়ে সব মহলে হৈচৈ পড়ে গেল তারপর থেকেই। শুরু হলো ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলন।
এ আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে, সরকার সমর্থিত ছাত্রদের রোষানলে এবং রাজনৈতিক হামলায় ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকরা রক্তাক্ত হয়েছেন, কিন্তু পাল্টা জবাব দিতে একটি ঢিলও ছুঁড়ে মারেননি কোথাও। এর প্রমাণও দিতে পারবে না কেউ। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। আন্তজার্তিক গণমাধ্যমগুলোতে পৃথিবীর ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ শিক্ষা আন্দোলনের পরিচিতি পায় নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন।
জীবনের মূল্য থেকেও অর্পিত ভ্যাট শিক্ষার্থীদের মনে যে কঠিন দাগ কেটেছে, তার উদাহরণ তখনকার প্রতিবাদী স্লোগানগুলো। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো রাজধানী। প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে ‘শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা আমার অধিকার’। রাষ্ট্রের কঠোরতায় শিক্ষার্থীরা স্লোগান পাল্টে ধরেন, ‘ভ্যাট দেব না গুলি কর, শিক্ষা আমার অধিকার’।
শিক্ষার্থীদের এত কঠিন প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের ভাষা ৬২ শিক্ষা আন্দোলনকেও নতুন করে নিয়ে এসেছে সবার সমানে। একদিকে সরকার অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের সাথে সারাদেশ। এই আন্দোলন আগত-অনাগত সবার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার খোরাক হবে বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবীদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ও সুশীসমাজ।
এই প্রথম, দেশকে আশা দেখিয়েছে যে শিক্ষার্থীরা, তারা সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার বাণিজ্যকরণ বন্ধে সরকারের ব্যর্থতাই দেখেছে আজ পর্যন্ত। ৬২ শিক্ষা আন্দোলনের পরে এত বড় একটি আন্দোলন জাতিকে উপহার দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশে যখন সুস্থ ও সংস্কৃত ধারার প্রতিবাদী আন্দোলন নেই, ঠিক সেই সময়ে উদাহরণ সৃষ্টি করলো ভ্যাট আন্দোলন। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের জন্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের রোল মডেল ও অদ্বিতীয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি ছাত্র আন্দোলন। পুরো আন্দোলনটি ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ ব্যানারেই সম্পূর্ণ হয়েছে। ৪ বছর শেষ হলো ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ আন্দোলনের। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে রক্তিম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
লেখক : আরিফ চৌধুরী শুভ, উদ্যোক্তা ও অন্যতম সংগঠক, নো ভ্যাট অন এডুকেশন, প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষা অধিকার আন্দোলন, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্ট (মাস্টার্স), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড