ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম
জীবন, জীবিকা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্ধানে অনেকেই নিজস্ব ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করেন। এই বসবাসের সময় নিশ্চয়ই কারও পক্ষে হঠাৎ বাড়ি-ঘর তৈরি করা সম্ভব হবে না। তাছাড়াও অর্থের বিষয়টিও জড়িত থাকে এ বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত ভাড়া বাসায়ই হয় তাদের একমাত্র অবলম্বন।
বাংলাদেশ শ্রমশক্তির জরিপ ২০১৭-১৮ থেকে জানা যায়, দেশের শতকরা প্রায় ২২ ভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। এর মধ্যে গ্রাম এলাকায় মাত্র ৩ ভাগ ও শহরাঞ্চলে থাকেন শতকরা ৪৩ দশমিক ৬০ ভাগ। দেশের রাজধানী শহরে এই সংখ্যার সঠিক কোনো জরিপ পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় শতকরা ৭০-৮০ ভাগ লোক ভাড়া বাসায় থাকেন।
আমাদের দেশের বিশাল একটা অংশ ভাড়া বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকলেও অধিকাংশই জানেন না যে, “বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১” নামে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন রয়েছে। আবার এই আইন অধিকাংশ বাড়িওয়ালাও হয়তো জানেন না। আবার জানলেও হয়তো অধিকাংশই মানতে চান না। আইন অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রকও আছেন। সাধারণত এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতগুলো।
সাধারণত দেশে যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকেন তারাই সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বজায় রেখে চলতে চান। তারা হয়তো কোনো প্রকার আইন-কানুন বিধি নিষেধেরও তোয়াক্কা করতে চান না। এই যেমন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়িওয়ালা নানা কারণে ভাড়া বাড়ান। আসলেই এটা বৈধ নাকি অবৈধ তা ভাবার সময় তাদের হয় না। হয়তো বা এসব আইন-কানুন সম্পর্কে আমরা ততটা ধারণাও রাখি না। তাই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে-
লিখিত চুক্তি :
আইন অনুযায়ী বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি নামা সই করতে হবে। যদিও এই চুক্তি নামা সইয়ের বিষয়টি অধিকাংশই এড়িয়ে চলেন। চুক্তিনামায় ভাড়ার মেয়াদ, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ভাড়ার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে। বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ইত্যাদিও কে পরিশোধ করবেন তা স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকবে।
জামানত থাকলে তা কবে ফেরত দেওয়া হবে, ভাড়ার সাথে সমন্বয় করে কাটা হবে কি না এসবও পরিষ্কার উল্লেখ থাকবে। এ সকল চুক্তির লিখিত দলিল হিসেবে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্টাম্প ব্যবহৃত হবে।
রশিদ :
বাড়ি ভাড়া প্রদান করে সেই সংক্রান্ত রশিদ ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালার কাছে বুঝে চাইবেন। বাড়িওয়ালাও দিতে বাধ্য থাকবেন। যদি এই রশিদ না দেন তবে বাড়ির মালিক আদায়কৃত ভাড়ার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অগ্রিম ভাড়া :
সাধারণত বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় মালিকপক্ষ অগ্রিম ভাড়া চেয়ে বসেন। আইন অনুযায়ী এটি নিষেধ নয়। তবে কোনোভাবেই এক মাসের ভাড়ার বেশি ভাড়া অগ্রিম নিতে পারবেন না।
ভাড়া বৃদ্ধি :
ভাড়া বৃদ্ধি করার প্রবণতা অধিকাংশ বাড়িওয়ালারই থাকে। বিশেষ করে নতুন বছর শুরু হলেই বৃদ্ধি করেন ভাড়া। কিন্তু বাড়িওয়ালা চাইলেই ভাড়া বাড়াতে পারেন না। সাধারণত দুবছরের কম সময়ে বাড়ি ভাড়া যাবে না। এই সময়ের পর বাড়াতে হলে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার আপসে নির্ধারিত হবে। এ ভাড়া নিয়ন্ত্রকও নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হলে বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে এই জরিমানা তিনগুণ হবে।
বাড়ি মেরামত :
সাধারণত বাড়ি মেরামত করার দায়িত্ব বাড়িওয়ালাই নিয়ে থাকেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু কিছু মেরামতের কাজ বাড়িওয়ালা করতে চান না। এজন্যই হয়তো দেখা যায় পানির লাইন, গ্যাস লাইন দিনের পর দিন নষ্ট থাকলেও বাড়িওয়ালা মেরামত করে দিতে চান না।
এমন পরিস্থিতিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে ভাড়াটিয়া আবেদন করতে পারবেন। তখন ভাড়া নিয়ন্ত্রক বাড়িওয়ালাকে মেরামতের নির্দেশ দিবেন। জরুরি মেরামত করার প্রয়োজন পড়বে এমনকিছুর জন্য ভাড়াটিয়া তিন দিনের সময় বেঁধে বাড়িওয়ালাকে নোটিশ দিবেন। যদি এই সময় বাড়িওয়ালা মেরামতের কাজ না করেন তবে ভাড়াটিয়া আনুমানিক খরচের হিসেব ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে নিজেই মেরামতের কাজ করতে পারবেন। মেরামত করার পর খরচ ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করা সাপেক্ষে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে আদায় করতে পারবেন।
উচ্ছেদ :
যারা ভাড়া বাসায় থাকেন তারা কমবেশি এই শব্দটির সাথে পরিচিত। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় জানি, বাড়িওয়ালার স্ত্রীর সাথে কোনো কারণে ভাড়াটিয়ার স্ত্রীর ঝগড়া লেগে গেল। দেখা যাবে বাড়িওয়ালাও বলে দিবে এই মাসেই বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
আইনানুযায়ী এভাবে হঠাৎই কাউকে বাসা থেকে উচ্ছেদ করা যায় না। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করছে কি না তা দেখতে হয়। যদি ভাড়া পরিশোধ করে তবে উচ্ছেদ করতে পারবেন না। আবার চুক্তিপত্র না থাকলেও যদি ভাড়াটিয়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই ভাড়া পরিশোধ করে থাকেন তাকেও উচ্ছেদ করা যায় না। মাসিক ভাড়ায় থাকা ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে নোটিশ দিতে হবে। আর বার্ষিক ইজারা বা শিল্প কারখানার চুক্তির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস পূর্বে নোটিশ দিতে হবে। অনেক সময় চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে যদি বাড়িওয়ালা টাকা নিয়ে থাকেন তবে চুক্তিপত্র নবায়ন করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।
মূল গেটের চাবি :
বাড়ির মালিকের কাছে মূল গেটের চাবি বুঝে নেওয়ার অধিকার ভাড়াটিয়ার রয়েছে। সুতরাং ভাড়াটিয়া মূল গেটের চাবি নিতে পারবেন।
বৈদ্যুতিক মিটার ব্যবহার :
সাধারণত ভাড়াটিয়ার জন্য আলাদা বৈদ্যুতিক মিটার দিতে হবে। এই মিটারের রিডিং দেখে রাখতে হবে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা উভয়কেই।
অনেক সময় বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াকে আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ব্যাচেলর হলে পাশের বাসার অবস্থা পর্যন্ত জানাতে ভুল করেন না। দিয়ে থাকেন সতর্কবার্তাও। যাতে তাদের সাথে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে। এসব বলার অধিকার বাড়িওয়ালার আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাড়িওয়ালা সামগ্রিক পরিবেশ, যেমন - বাড়ির আশপাশে চলাচল করা কতটা নিরাপদ, নেশাখোরদের আড্ডা, চাঁদাবাজদের উৎপাত ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো ধারণা দেন না। তবে এসব সম্পর্কে অবহিত করা কিন্তু বাড়িওয়ালারই দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র : bdlaws.minlaw.gov.bd
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড