• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হাসপাতাল অব্যবস্থাপনায় পিষ্ট নাগরিক অধিকার!

সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি হাসপাতালের অর্থ বাণিজ্য

  এস এম সহাগ

০৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০২
রোগীদের মৌলিক অধিকার
সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির বাস্তব চিত্র। ছবি : সংগৃহীত।

প্রতিটা দেশের প্রাণ তার নাগরিক, নাগরিকদের অধিকার উপেক্ষা করে রাষ্ট্রযন্ত্র কখনোই সচল থাকতে পারে না, নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে রাষ্ট্র মুখ থুবড়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। এর বাস্তবায়ন সব সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। এটি নিশ্চিত করায় যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি গ্রহণের জন্যও নাগরিক এর দায়িত্ব রয়েছে।

সরকার এবং নাগরিক এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে স্বাস্থ্য সেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৌশলগুলো নিয়ে কাজ করা এখন জরুরি। দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সেবা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেবাপ্রদানকারী - সেবাগ্রহণকারীর মধ্যে নানা দিক থেকেই উপলব্ধির ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।

নানাবিধ অজ্ঞাত কারণে রাষ্ট্রের চিকিৎসকরা সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মধ্যে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাই মুখ্য একটি কারণ। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরকারিভাবে চিকিৎসা প্রদানের জন্য যেটুকু সময় বরাদ্ধ পেয়ে থাকেন নানা কারণে সেটুকু সময় সাধারণ মানুষকে তার কাছে আসতে দেয়া হয় না বা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে থাকতে দেওয়া হয় না।

ছবি : সংগৃহীত

‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যালোচনা’ শীর্ষক শিরোনামে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) ২০১৫ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়।

‘নাগরিক অধিকার সনদ’

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় চিকিৎসা সেবায় নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০০৭ সালে সর্বশেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, ২০১৪ সালে মন্ত্রণালয় ও কিছু বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে নাগরিকদের চিকিৎসা সেবার ওপর জোর দেয়ার জন্য প্রচারণা চালায়।

নাগরিকদের ‘স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির অধিকার’ এর ওপর কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত করে দেয়া হয় ঐ সনদে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতালসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয় ঐ প্রচারণা সনদে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পেছনে কিছু চ্যালেঞ্জ ও তুলে ধরা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে।

প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুলতা, নাগরিক ও সরকারি পর্যায়ে আইন প্রতিষ্ঠায় সদিচ্ছার অভাব। বিপুল জনসংখ্যার রাষ্ট্রে প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য সংখ্যক চিকিৎসকের অভাব, সেবা প্রদানকারী সংগঠনের আন্তরিকতার অভাব, ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির ও অনিয়মের দৈরাত্ম্যসহ নানাবিধ পর্যায়ে নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। ‘বিশ্বব্যাংক – ২০১০’

দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলো স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি, পৃথিবির প্রায় সব উন্নত দেশেই নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা প্রদানকে সরকারের মুখ্য দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে আমাদের সোনার বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে সরকারি হাসপাতাল যেন এক বিভীষিকার নাম, এক স্পর্শকাতর অভিজ্ঞতার স্থান। যেখানে সুস্থ হতে যাওয়ার কথা সেখানের পরিবেশ যেন রোগীকে আরও অসুস্থ করে তোলার জন্যে। এসবের পেছনে অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতাই দায়ী।

বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের চিত্র :

বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাব মতে, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতি ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জনপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় ধার্য করা হয় ২৬ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার যা একজন নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবায় সরকারের বাজেট থেকে খুব স্বল্প পরিমাণেই যুক্ত হয়, নাগরিকদের পকেট থেকে যুক্ত হয় ২৬ শতাংশ এবং বাকিটা আসে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন তহবিল থেকে।

বাংলাদেশের সরকারের বাজেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার ব্যায়ের মোট পরিমাণের মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশই যুক্ত হয়। এই সামান্য অর্থ দিয়ে নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবার কিয়দাংশই পূরণ হয়। এমনকি কোনো রোগীকে যদি উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে তখন তাকে নিজের সর্বস্ব ব্যয় করে দেশের বাহিরে যেতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে কোন সহযোগিতা তো থাকেই না উল্টো রোগীকে দেশের বাইরে যেতে যেসব আনুষ্ঠানিকতার দরকার সেখানে পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ।

সরকারি বনাম বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র। ছবি : সংগৃহীত

২০১২-২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়িয়ে ২৬ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবং বহিরাগত অনুদান ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের অংশগ্রহণের সুফল কতটা দৃশ্যগত হবে তা এখন শুধু দেখার বিষয়।

রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব না থাকলেও কেবলমাত্র সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় সেবাবঞ্চিত থাকছে রোগীরা। ডাক্তারের অবর্তমানে ওয়ার্ডবয় আর নার্সদের গাফিলতিতে আয়ারা হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। এর বাইরে রয়েছে দালালদের উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন অভিযোগও রয়েছে সরকারি কোনো কোনো হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও টাকা গুণতে হয় স্বজনদের।

রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে বাড়তি টাকা কামাচ্ছে বহিরাগতরা। ছুটির দিনে আর রাতের বেলায় হাসপাতালগুলোর চেহারা আমূল পাল্টে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি করেও ডিউটি ডাক্তারদের পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। দরজা আটকে বিশ্রামে থাকা নার্সদের ডাকলে রীতিমতো রক্তচক্ষু দেখতে হয়। অনেক হাসপাতালের আঙিনাসহ চারপাশে ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। কোনো কোনো হাসপাতাল ঘিরে রয়েছে ঝুপড়ি বস্তি আদলে ঘরবাড়ি। কোথাও কোথাও দোকান-পাটের জঞ্জালে ঠাঁসা।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহালদশায় চিকিৎসা সেবার পরিবর্তে দিনদিনই রোগী ভোগান্তি বাড়ছে। রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালের মর্গের অবস্থা করুণ। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো দিনের পর দিন পরীক্ষাধীন লাশগুলো পড়ে থাকছে হাসপাতালের মর্গের ফ্লোরে। এসব লাশের অভিভাবকরা আক্ষেপ করে বলেছেন, মরেও ভোগান্তির অবসান হলো না।

সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের করুণ চিত্র। ছবি : সংগৃহীত

সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও তা পাওয়া যায় না। একথা অস্বীকার করা যাবে না দেশে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি হাসপাতাল অপ্রতুল। হাসপাতালগুলোতে প্রায়শই দেখা যায় রোগীদের উপচে পড়া ভিড়, এর ওপর রয়েছে নানা অনিয়ম। কদিন আগে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মর্মান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে এই বিশেষ দালালদের কারণেই রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

সরকারি হাসপাতালে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হাসপাতাল চত্বর দালাল ও মস্তানদের দখলে থাকা অনাকাঙ্ক্ষিত। কেন এবং কোনো অঘোষিত নীতিতে এটা হচ্ছে বা হতে পারছে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্থানেই যদি এমন হয় তাহলে দেশের নাগরিকদের দেশপ্রেমের স্থান একদিন শূন্যের কোটায় পৌঁছাবে।

কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে ২১ শতাংশ চিকিৎসা যন্ত্রপাতির প্যাকেটই খোলা হয় না। ১১ শতাংশ ব্যবহারের আগেই নষ্ট হয়ে যায়, ১১ শতাংশ যন্ত্রপাতি ঠিক থাকলেও ব্যবহারই করা হয় না, ১০ শতাংশের ব্যবহার হয় আংশিক। বাকি থাকল ৪৭ শতাংশ। জরিপে সে সম্পর্কে তথ্য না থাকলেও সাধারণ রোগীরা যে বঞ্চিতই থেকে যায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জরিপে উদ্ঘাটিত তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কারণ, এটা বিশ্বব্যাংক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ওষুধ ভান্ডারের পরিচালিত জরিপ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশিরভাগ প্রকল্পই বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চলে। কিছু আছে সরকারি, যা জনগণের করের টাকায় চলে। এসব প্রকল্পের সুফল যদি জনগণ না পায়, তাহলে সরকারি হাসপাতাল কার জন্য?

২০১৪ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে একটি দামি মেশিন আমদানি করে বিল পাস করিয়ে নেওয়ার পর দেখা গেল বাক্স খালি। সেখানে কোনো যন্ত্র নেই। তদন্তে জানা গেছে, জুন মাসের মধ্যে যন্ত্রপাতি আমদানির কাগজপত্র দেখাতে না পারলে তা বাতিল হয়ে যাবে বলে নিজেদের মধ্যে যোগসাজসে খালি একটি বাক্স দেখানো হয়েছে। পরে সেই যন্ত্র আদৌ আসবে কি না, তা কে জানে? কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা হলো, কর্তৃপক্ষ জেনেশুনে এসব অনিয়মে মৌন সম্মতি দেয় কেন? এর পথ ধরেই তো বড় বড় দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব ক্ষেত্রে অর্থবছর শেষ হওয়ার পরও বিশেষ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে হয়তো কিছু অনিয়মের সুরাহা হতে পারে।

সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে সাধারণ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যত কঠিন একটু সিনিয়র বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া তুলনামূলক ভাবে তার চেয়ে সহজ। যে কারণে রোগী একবার টিকে গেলে সাধারণত সুস্থ হয়েই ফিরে যেতে সক্ষম হন। যদিও হামেশাই তার সেবা প্রদানকারী সঙ্গীটি সাথে অন্য রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরেন।

বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র :

‘বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে সম্পূর্ণ মুনাফা-ভিত্তিক বাণিজ্য চলছে: টিআইবি’ শীর্ষক শিরোনামে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বিবিসি বাংলা’ একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে দেশের বেসরকারি চিকিৎসার নামে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে নিয়ে কীভাবে বাণিজ্য চলছে তাঁর চিত্র তুলে ধরা হয়।

একটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিল পরিশোধ না করায় লাশ আটকে রাখার চিত্র। ছবি : ডেইলি সান

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে চিকিৎসা সেবার মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণার পর দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বছরে বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু সেখানেও বাণিজ্যিক মুনাফাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ নেই। তাই সুযোগ সঠিকভাবে না মেলায় অধিক খরচ করে বেসরকারি চিকিৎসা সেবার দিকে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেখানেও বাণিজ্যিক মুনাফাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘বেসরকারি খাতের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে ব্যাপক মানুষের হতাশা আছে বাস্তবসম্মত কারণে। হাসপাতাল-ক্লিনিকের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান চলছে সেখানে বাস্তবে যারা প্রশিক্ষিত সেবা-দানকারী থাকার কথা তার বিপরীতে বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সেবা দানকারীরা সুযোগ নিচ্ছে’ বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি আরও বলেন, ‘চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত আইনের ঘাটতির কারণে মুনাফা ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেখানে আইনের নীতি প্রয়োগের ঘাটতি এবং নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই।’

বেসরকারি চিকিৎসা খাতের অনিয়মের বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরা হয় টিআইবির পক্ষ থেকে : স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই

•নিয়মিত তদারকি না থাকায় সেবার অতিরিক্ত মূল্য, চিকিৎসার নামে সম্পূর্ণ মুনাফা-ভিত্তিক বাণিজ্য হচ্ছে। •বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়না, •প্রতারণা-নির্ভর হচ্ছে অর্থাৎ অনেক সময় চিকিৎসার নামে প্রয়োজনের তুলনায় আরও বেশি ব্যয়-সম্মত চিকিৎসা রোগীদের অফার করা হচ্ছে। •কোনো কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযোগ দাখিলসহ নিরসন প্রক্রিয়ার কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা নেই।

চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নামে অভিশাপ :

বাম পাশে ইউনাইটেড হাসপাতাল ডান পাশে ঢাকা শিশু হাসপাতাল। ছবি : সংগৃহীত

দেশে বৈধ লাইসেন্সে মাত্র ৭ হাজার ৬০০ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দেড় লাখ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় হাসপাতাল খুলে বসেছেন। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। আর এ সুযোগে রাজধানীসহ দেশের যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মমতাজ উদ্দিন ভূঞার মতে, সরকারি বৈধ অনুমোদন নিয়ে সারা দেশে ২ হাজার ৭১৮টি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ৪ হাজার ৫৯৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। তবে অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের মতে, শুধু রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ২০ হাজারের বেশি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন হাজার লাইসেন্স চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রাথমিক আবেদনপত্র পাঠালেও আর কোনো যোগাযোগ করেনি।

এই খাতেও সরকারি খাতের চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে এবং এ কারণে দুটি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি সেবা-খাতেও পর্যাপ্ত সেবা তারা দিতে পারছেন না আবার বেসরকারি খাতে যখন আসছেন মানসম্পন্ন চিকিৎসা দিতে পারছেন না। দুই খাতের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্থানটা।

হাতুড়ে দন্তচিকিৎসক। ছবি : সংগৃহীত

নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত সকল পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলে রাষ্ট্র তাঁর প্রাণ নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কিছুটা হলেও সফল হতে পারে।

• সঠিকভাবে সরকারি ঔষধ সরবরাহ এবং বিলি নিশ্চিত করা । • ডাক্তারদের চাকরির বয়স এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রমোশনের ব্যবস্থা করা। • প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে অন্তত একজন পাবলিক রিলেসন্স অফিসার নিয়োগ। • একই ডাক্তার দিয়ে যাবতীয় জটিল রোগের চিকিৎসার সনাতনি পদ্ধতি পরিহার। • জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে অবস্থানরত ডাক্তারদের শহরের তুলনায় বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা। • প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিত্সক, নার্স এবং মেডিকেল ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা করা। • যেসব ব্যক্তিবর্গ হাসপাতাল পরিচালনা করেন তাদের দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা উচিৎ। • প্রতিটি ডাক্তারকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এফসিপিএস ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করা। • সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্র ক্লোজ মনিটরিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ। যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই সম্ভব। • হাস্যকর মনে হলেও বলব এলাকার প্রতিটি জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি অফিসারদের স্থানীয় সরকারী নিরাময় কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। • অনতিবিলম্বে দেশে প্রয়োজনানুযায়ী মানসম্মত মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। যেখান থেকে বেড়িয়ে আসবেন চিকিৎসক–নার্স যা আমাদের দেশের চিকিৎসক–নার্স এর ঘাটতি পূরণে করতে সক্ষম হবে।

•কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং এর পরিচালকদের এ পেশাটাকে মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। সেবা দিয়ে সম্মানি নিবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সুদের কারবারিদের মতো সন্তানকে, রোগীকে আটকে রাখেন কী করে!

স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সরকারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীরা সেবা নিতে আসেন মূলত : বিনামূল্যে মান সম্মত চিকিৎসার আশায় । গরীব রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল এই সরকারি হাসপাতাল। আর তাই প্রয়োজন যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা খাতের আমূল পরিবর্তন। এভাবেই একদিন হয়তো দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে সোনার বাংলার স্বাস্থ্যসেবার চিত্র পাল্টে যাবে বলে আশা করা যায়।

মানুষের অধিকার নিয়ে লিখবে অধিকার; লিখুন আপনিও। আপনার চারপাশে অধিকার বাস্তবায়নে আপনিও সচেষ্ট হোন, জানান সরাসরি দৈনিক অধিকারকে [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড