নিশীতা মিতু
একজন নারীর জীবনের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম একটি হল নিজের স্বাস্থ্যের অধিকার। আর এই অধিকারের অংশ হল যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকার। তবে সেই অধিকারের কতটুকুই বা বাস্তবায়িত হচ্ছে একজন নারীর জীবনে? নিজের দেহ, নিজের জীবন, ইচ্ছা আর কর্তৃত্ব অন্য কারোর, কী অদ্ভুত তাই না?
প্রেক্ষাপট ১- হাসপাতালের বিছানার শুয়ে আছে শিলা (ছদ্মনাম)। কারও সঙ্গে খুব একটা কথাও বলছে না। ১৬ বছরের এই কিশোরী হাসপাতালে এসেছিল সন্তান প্রসবের জন্য। মৃত সন্তান প্রসব করেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও নানা জটিলতার কারণে নিজেও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে আছে।
এসএসসি পরপরই মা বাবা বিয়ে দিয়ে দেয় শিলার। বিয়ের পর স্বামী যতটা না বন্ধু তার চেয়ে বেশি কর্তা হয়েছিল। সন্তান গ্রহণ করতে আপত্তিও জানিয়েছিল, তবে ৩০ বছর বয়সী স্বামীর সন্তানের তাড়া ছিল। আর ফলাফল, হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো শিলা। কিশোরী বয়সে বিয়ে, শারীরিক সম্পর্ক, গর্ভধারণ, মৃত সন্তান প্রসব— পরপর এতগুলো ধাক্কায় মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত সে। অথচ নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল তার। নিজের দেহ বা মনের কতটুকু অধিকার পেল সে?
প্রেক্ষাপট ২- নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিসেস সাবিহা (ছদ্মনাম)। নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছেন ৩ বছর হল। নিজেদের পরিবার পরিকল্পনা স্বামী-স্ত্রী ঠিকই গুছিয়ে নিয়েছেন। সংসার, চাকরি সব মিলিয়ে সন্তান গ্রহণে কিছুটা সময় নেওয়ার পক্ষেই তারা।
তবে চারপাশের মানুষগুলোর যেন তাদের চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। এতদিন হয়ে গেল, সন্তান নিচ্ছে না কেন? সন্তান নেওয়ার জন্য এত প্ল্যানের কী আছে? সংসারে মন নেই বলে সন্তান নিচ্ছে না—এমন বহু কটু কথার সম্মুখীন হচ্ছেন নিয়মিত। কেউ কেউ আবার সাবিহার সন্তান ধারণের ক্ষমতাকেও করছেন প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছু মিলিয়ে বেশ বিব্রত এই দম্পতি।
মিসেস সাবিহা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘চারপাশের মানুষগুলোর প্রশ্ন শুনলে মনে হয়, নিজের সন্তান ধারণের অধিকারটুকুও আমাদের নেই। একটা সন্তান জন্ম দিলেই হয় না, তার জন্য সুন্দর পরিকল্পিত আর গোছানো একটা পৃথিবীও তৈরি রাখতে হয়, এই বিষয়টি বোধহয় তারা বোঝেন না। নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে অন্যদের মাথ্যা ব্যথা দেখলে বেশ বিব্রত হই।’
উপরে দু’টি প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলেও তা প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের পুরো সমাজকে। নিজের দেহ, যৌন বা প্রজনন অধিকার বলে যে একজন নারীর জীবনে কিছু থাকতে পারে তাই হয়ত ভাবেন না কেউ।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফে’র হিসেবে, বাংলাদেশে এখনও ৫৯ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হবার আগেই। অর্থাৎ, অর্ধেকও বেশি মেয়ের জীবনে সঠিক বয়সে বিয়ে হওয়ার অধিকার অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সম্প্রতি করা এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এসব নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা। নিজের দেহ বা নিজের জীবনে নিজের মতো বাঁচার অধিকার তবে কতটাই পাচ্ছে নারীরা?
জীবন নিজের তবে সিদ্ধান্ত অন্যের। বিয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে মা-বাবার ওপর। শারীরিক সম্পর্কের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে স্বামীর ওপর। সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে স্বামী বা স্বামীর বাড়ির মানুষজনের ওপর। অধিকাংশ নারীর জীবনের করুণ বাস্তবতার রূপ এমনই।
নিজের দেহ নিয়ে কথা বলা সমজের চোখে লজ্জার বিষয়— এমনটাই ভাবনা অনেকের। অথচ, আমাদের সবারই জানা স্বাস্থ্য অধিকার একজন মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। আর প্রজনন স্বাস্থ্য মূলত সামগ্রিক স্বাস্থ্যেরই একটি অংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিকভাবে শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক কল্যাণের সমন্বয়ে সন্তান জন্মদানের পরিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আর এই প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তমূলক বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্বেচ্ছায় পছন্দের বিয়ে করা, সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত এবং নিজ নিজ অধিকার চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবার অধিকার ভোগ করা। এই অধিকারের কতটুকু ভোগ করেন একজন নারী?
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী স্বাস্থ্য বিষয়টিই অবহেলা। সেখানে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার প্রশ্নই আসে না। আমাদের বুঝতে হবে একজন নারীর জীবন যৌন ও প্রজনন অধিকার তার মৌলিক অধিকারেরই অংশ। তাকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। তবেই না আমরা পাবো সুন্দর আর সমৃদ্ধ একটি সমাজ!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড