• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

চামড়ার দরপতন এবং সরকারের রপ্তানির সিদ্ধান্ত

  জোবায়ের আহমেদ

০১ আগস্ট ২০২০, ১৮:৪০
চামড়া শিল্প
ছবি : সংগৃহীত

দেশে সম্ভাবনাময় শিল্পের মধ্যে অন্যতম চামড়াশিল্প। পোশাক শিল্পের পরেই রপ্তানি আয়ের দিক থেকে চামড়াশিল্পকে বিবেচনা করা হয়। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণ ধরায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে নেওয়া হয়। এই শিল্প নগরীতে ১৫৪ টি ট্যানারি প্লেট রয়েছে এবং এর মধ্যে উৎপাদনে আছে ১২৫ টি।

পরিবেশ বান্ধব চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তুলতে ২০১৪ সালের শুরুতে চামড়া শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। দেড় বছরের মধ্যে সিইটিপি নির্মাণের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও গত সাত বছরেও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।

এদিকে প্রকল্পটি শেষ করতে ইতোমধ্যে ১৪ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সবশেষ সময় পার হয়েছে গত জুন মাসে। তারপরেও বহুল প্রত্যাশিত এই সিইপিটির কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে ট্যানারিগুলোর বর্জ্য ধলেশ্বরীর নদীতে ফেলা হয়।

শিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকায় চামড়াশিল্পে বৈশ্বিক সংস্থার মান সনদ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে বাংলাদেশ এখনো লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডাব্লিউজি) এবং আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) থেকে কোনো সনদ পায়নি। কোনো দেশের এই সনদ না থাকলে সে দেশের চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আমদানি করতে উৎসাহ দেখায় না। ফলে বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে চামড়া শিল্পের আধুনিকীকরণ ও রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হলো চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বড় ধরনের ঘাটতি।

দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যার বাস্তবচিত্র শেষ ৫ বছরের রপ্তানি আয় দেখেই বোঝা যায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১১৬০.৯৫ মিলিয়ন ডলার। পরের বছর (২০১৬-১৭) রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ১২৩৪ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.২৯ শতাংশ। পরের বছর এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে যায় ১২.০৩ শতাংশ। সে বছর (২০১৭-১৮) রপ্তানি হয় ১০৮৫.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় আরও ৬.০৬ শতাংশ কমে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১০১৯.৭৮ মিলিয়ন ডলার।

সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) আট মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ৬৩ কোটি ১৮ লাখ ডলারের সমপরিমাণ। আগের অর্থবছরে একই সময়ের চেয়ে যা ৯ শতাংশ কম। আর এই আট মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ কম। যেখানে ২০২১ সালের মধ্যে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ কোটি ডলার। এখন বাস্তবে যা কল্পনার বাইরে।

অন্যদিকে কয়েকটি স্থানীয় ব্র্যান্ডের জুতা বিদেশিরা ক্রয় করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারিগুলো পরিবেশ দূষণ রোধ না করে লেদার উৎপন্ন করে বিধায় বাংলাদেশি লেদার ব্যবহার করে প্রোডাক্ট তৈরি করলে বিদেশীরা তা নিতে আগ্রহ বোধ করে না। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত অনুযায়ী এসব পণ্য তৈরি করতে হলে তাদের পছন্দমতো দেশ থেকে চামড়া কিনে আনতে হবে।

এক্ষেত্রে কোথায় থেকে চামড়া কিনতে হবে সেই দেশের নাম ও কোম্পানির নামসহ বলে দেয় বিদেশি ক্রেতারা। এ কারণে এসব বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশের চামড়া কাজে লাগাতে পারছে না।

যার কারণে বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোতে এখনো চামড়ার স্তূপ এবং ওয়েট ব্লু লেদারের স্তূপ পড়ে আছে। এগুলোকে কোনো কাজে লাগাতে পারছে না ট্যানারিগুলো। এর ফলে দেশীয় ট্যানারি মালিকরা বেশি দামে চামড়া ক্রয় করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এক সময় ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ফিনিশড চামড়া ক্রয় করত। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে তারা এখন অন্যত্র চলে গেছে। বাংলাদেশের নির্ভরতা বেড়েছে চীন, হংকংসহ কয়েকটি দেশের নন-ব্র্যান্ড ক্রেতাদের ওপর।

বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনের ফিনিশড পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমেছে। ফলে সেখানকার ব্র্যান্ডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে চামড়া ক্রয় করা কমিয়ে দিয়েছে চীন। আর সুযোগ বুঝে অন্য ব্র্যান্ডগুলো সুবিধা নিচ্ছে। যাচ্ছেতাই দামে ফিনিশড চামড়া ক্রয় করছে, যার ফলে দেশে চামড়ার দাম ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং তা সুস্পষ্ট দেখা যায়। যেখানে ২০১৩ সালে গরুর চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, সেখানে এ বছর এই চামড়ার দাম ২৮ থেকে ৩২ টাকায় নেমে এসেছে।

ঠিক এই মুহূর্তে এসে সরকার কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু লেদার রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়। যার কারণে সাধারণ জনগণ এবং ট্যানারির মালিক সবাই খুশি। এতো বছরের চামড়ার স্তূপ এবং ওয়েট ব্লু লেদার ও রপ্তানি করার সুযোগ পাবে ট্যানারির মালিকরা। সাধারণ জনগণ ও চামড়া বিক্রি করতে পারবে তুলনামূলক বেশী দামে।

আরও পড়ুন : স্ব স্ব বিদ্যাপীঠে ফেরার অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা

মজার বিষয় হলো, ওয়েট ব্লু লেদার এবং চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে এদিকে ট্যানারির মালিকরা চামড়া, ফিনিশড লেদার এবং ওয়েট ব্লু লেদার অল্প দামে বিক্রি করে দিবে এবং দেশের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত পূরণ করার জন্য আবার ওয়েট ব্লু লেদার অথবা ফিনিশড লেদার বাইরের দেশ থেকে আরও বেশি দাম দিয়ে কিনে আনবে। অথচ সিইটিপি স্থাপন করলে ব্র্যান্ডগুলো নিজের দেশের লেদার ব্যবহার করে প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারে। যাতে করে রপ্তানি আয় আরও বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব।

অতএব ট্যানারির মালিকদের সমস্যা এবং সাধারণ জনগণের চামড়ার প্রকৃত মূল্য না পাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো সিইটিপি স্থাপনের প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব, খামখেয়ালিপনা এবং অতিরিক্ত সময় নেওয়া। শিল্প নগরীগুলোতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ খুব দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করে সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড