• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তিত হওয়ার গল্প

  মোস্তাফিজুর রহমান রাকিব

০৮ জুলাই ২০২০, ২১:৪৩
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি : সংগৃহীত

প্রকৃতিতে এখন বর্ষাকাল। যদিও এখনো গ্রীষ্মের আমেজ কাটেনি। চারদিকে জ্যৈষ্ঠের সুমিষ্ট ফলের ঘ্রাণ। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় চারপাশের চিরচেনা রূপ চোখে না পড়লেও সময় ঠিকই কেটে যাচ্ছে। দিনের পিঠে আসছে রাত। ঠিক তেমনিভাবে বছর ঘুরে ঘুরে পূর্ণ হতে চলেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হারুন উর রশিদ আসকারীর দায়িত্বের মেয়াদকাল।

২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ১২ তম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারী ইবির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ইবিকে তৈরি করেছেন ইতিবাচক পরিবর্তনের রোল মডেল হিসেবে। তবে তার চলার পথ অতোটা মসৃণ ছিল না। দায়িত্ব গ্রহণের পর তাকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অসংখ্য সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। নিজ গাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন। তবুও তিনি পিছু হটেননি। তার মতে, শান্ত সমুদ্রে কখনো দক্ষ নাবিক হওয়া যায় না।

মজার বিষয় হচ্ছে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন উপাচার্য হটাও আন্দোলন হয় ড. রাশিদ আসকারী তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অ্যাকাডেমিক ও অবকাঠামোগত ভাবে ইবিকে ঢেলে সাজিয়েছেন নতুন রূপে। দিয়েছেন সুনিপুণ গাঁথুনি। করেছেন আমূল রূপ পরিবর্তন। দায়িত্ব নিয়েছেন হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের। খ্যাতি অর্জন করেছেন আধুনিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার হিসেবে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে গত চার বছরে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ ও বিদেশে ছিল ইবিয়ানদের জয়জয়কার। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করেছে এ বিদ্যাপীঠ।

আর এসব নিয়েই আমাদের আজকের, একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তিত হওয়ার গল্প।

উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. রাশিদ আসকারীর প্রধানতম চ্যালেঞ্জ ছিল নানা কারণে ভাবমূর্তি সঙ্কটে নিমজ্জিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। সেই সাথে একটি প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনি অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে যেমন চমক দেখিয়েছেন তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলদের গুদামঘর খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীলতা চর্চার উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। উন্মোচন করেছেন মুক্ত চিন্তার দ্বার। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হারুন উর রশিদ আসকারীর একাধিক পরিচয় রয়েছে। তিনি একাধারে বাংলা-ইংরেজি লেখক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ড. রাশিদ আসকারী নামে তিনি সমধিক পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ১৯৯০ সালে ইবিতে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০০৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তিনি ইবির ইংরেজি বিভাগে মোট তিনবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে ছাত্র উপদেষ্টা, ইবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার এ পর্যন্ত বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে ৮ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ২৫। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ১২ টি।

মূলত তার শুরুটা হয়েছিল দুর্নীতি ও সেশনজটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। একারণে শুরুর দিকেই তিনি ক্যাম্পাসের কর্ম ঘণ্টা বৃদ্ধি করে সকাল ৯ থেকে বিকাল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত করেন (যা পূর্বে ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত)। ফলে অধিকাংশ বিভাগ থেকেই উল্লেখযোগ্য হারে সেশনজট যেমন কমে এসেছে ঠিক তেমনি ভাবে কর্ম ঘণ্টা বৃদ্ধির ফলে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। পরিবর্তনের শুরুটা এখান থেকেই, এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

দীর্ঘ ১৬ বছর পর ৪র্থ সমাবর্তন আয়োজন করেছেন। ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি এটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১০ হাজার ডিগ্রীধারীসহ প্রায় ১৪ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যা ছিল দেশের সর্ববৃহৎ সমাবর্তন। বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া। প্রথমবারের মতো ৫ বছর (২০১৬-২০২১) মেয়াদী মডেল অর্গানোগ্রাম অনুমোদন। ৫টি অনুষদকে ৮টিতে বর্ধিতকরণ। ২৫টি বিভাগ হতে ৩৪টিতে উন্নীতকরণ। ৬৮ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান। ৪টি সুষ্ঠু ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন। বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি। এমফিল-পিএইচডি নীতিমালা আন্তর্জাতিকীকরণ। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি অটোমেশন, রেজাল্ট প্রোসেসিং সফটওয়ার সংযুক্ত, কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি ও ইনোভেশন ল্যাব স্থাপন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এমওইউ ইত্যাদি ইবিকে নিয়ে গেছে অসীম উচ্চতায়। গত ৪ বছরে ইবিতে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সেমিনার, মতবিনিময় সভা, কর্মশালাসহ নানামুখী উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো। আর এসবের পেছনে রয়েছে একজনের সময়োপযোগী চিন্তাধারা ও নিরলস প্রচেষ্টা। তিনি আর কেউ নন, তিনি ড. রাশিদ আসকারী।

মোটা দাগে ইবির অবকাঠামো খাতে গত ৪ বছরে হয়েছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। এ বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় প্রধান ফটকে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনিন্দ্যসুন্দর ম্যুরাল মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিবের কথা।

এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্পের আওতায় ৫৩৭ কোটি ৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রাপ্তি। এতে রয়েছে ১৮টি ভবনের বর্ধিতকরণ ও ৯টি দশ তলা বিল্ডিং। ইতোমধ্যে নানাবিধ বাধা উপেক্ষা করে ১৮টি ভবনের ভার্টিকেল নির্মাণকাজ চলছে। ৯টি দশ তলা ভবনের ডিজাইন শেষে টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান। পূর্বের প্রশাসনের সময়ে ২য় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত (কিন্তু অব্যবহৃত) ৭১ কোটি টাকার প্রোজেক্ট টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে যা সমালোচক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট ১৫৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বরাদ্দ ছাড়াও তাঁর সময়ে পূর্বের চেয়ে অভ্যন্তরীণ আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বাজেট ঘাটতি কমে এসেছে বিশগুণের বেশি। বিগত সময়ের ১৯টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে নেই কোনো অডিট আপত্তি।

ড. রাশিদ আসকারীর সময়ে পরিবহন নির্ভর ইবির পরিবহন পুলে যুক্ত হয়েছে ১৪টি বাস, ১টি ডাবল ডেকার, ৮টি এসি গাড়ী ও ১টি অ্যাম্বুলেন্স। অপরদিকে আবাসন সঙ্কট সমাধানে ৩য় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্প শেষে ইবি পরিবারের সকল স্তরের ৮৫% আবাসন নিশ্চিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর বাইরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার ও একুশে কর্নার স্থাপন। সৌন্দর্য বর্ধনকারী সততা ফোয়ারা, বঙ্গবন্ধু হলের সম্মুখে শাশ্বত মুজিব ও মুক্তির আহবান নামক দুটি ম্যুরাল, পুরো ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, লেকের সৌন্দর্য বর্ধন এ সকল কিছুই আজ চর্মচোক্ষে দৃশ্যমান।

আরও পড়ুন : প্রবাসী অধিকার পরিষদ গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়েছি এবং হচ্ছি

ড. রাশিদ আসকারী মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাইতো শিক্ষার্থীদের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে তিনি সর্বদা আন্তরিক। তার নির্দেশনায় ইবিতে মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হয়। এজন্য তাকে বিভিন্ন সময় নানা সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে সরকারের সাফল্য, অগ্রযাত্রা বাস্তবায়নে অবিরাম কাজ করে চলেছেন।

ইবিতে ইতিপূর্বে কোনো উপাচার্য তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। এ বছরের আগস্ট মাসের শেষের দিকে ড. রাশিদ আসকারীর মেয়াদ পূর্ণ হবে। তিনি কি পারবেন তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে? তার স্বপ্ন এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের বিদ্যাপীঠে রূপান্তর করা। তবে করোনা প্রাদুর্ভাবে যা কিছুটা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহের সুষ্ঠু ‍ও পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং মেগা প্রকল্পের অবশিষ্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে অধ্যাপক আসকারীর দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ৪ বছরে তিনি তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে বিকল্পহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, ইবির সর্বক্ষেত্রে দিয়েছেন পরিবর্তনের ছোঁয়া। তাইতো এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চাওয়া, শুধু মেয়াদ পূর্ণ নয় পিছিয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিতে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন উর রশিদ আসকারীর বিকল্প নেই।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড