• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মণিপুরি মুসলমানদের সমস্যা দূরীকরণে গণমাধ্যমের করণীয়

  রফিকুল ইসলাম জসিম

২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৪৩
প্রচ্ছদ
ছবি : প্রতীকী

এ দেশের বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে প্রায় দুইশ বছর ধরে মণিপুরি মুসলমানরা নিভৃতে জীবনযাপন করে আসছে। নিরহংকার ও আত্মাভিমানী এ জাতি বহুকাল ধরে এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে নীরবে সহাবস্থান করে আসলেও নানাবিধ সমস্যা আর বঞ্চনায় জর্জরিত। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের জীবন আজ বিপন্ন।

অনেক সময় এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি সাহায্য সংস্থাসমূহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কেবল এদের ধর্মীয় অবয়বের কারণে বঞ্চিত হচ্ছে। ভাবটা এমন, মুসলমানরা আবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হয় কীভাবে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে নির্লিপ্ততা থাকাও এদের বঞ্চিত হওয়ার একটা মুখ্য কারণ। এসব কারণে মণিপুরি মুসলমানদের মৌলিক অধিকারও অনেকাংশে খর্ব হচ্ছে। এ অন্তর্মুখী সমাজকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণাও খুব একটা হয়নি। ফলে এদের নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখারও অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সে দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। ফলে মণিপুরি মুসলিমদের অভাব-অভিযোগ যথার্থভাবে উত্থাপিত হয়নি, ফলে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কোনো সুরাহাও হয়নি।

সাংস্কৃতিক যুদ্ধেও পিছিয়ে যাচ্ছে মণিপুরি মুসলিমরা। একটি সমাজকে জাগিয়ে তুলতে লিখনি শক্তিকে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। লেখকরা হচ্ছে জাতির বিবেক। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের মূল কারিগর হলো লেখক সমাজ। তাদের ভূমিকা যেমন একটি সমাজকে জাগিয়ে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি তাদের নীরবতায় একটি সমাজ নির্লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। আজকে মণিপুরি মুসলিম সমাজের পরিবেশ কিছুটা হলেও নির্লিপ্ত। কারণ এখানে লেখকের প্রাতুলতা রয়েছে। যারা দুই-একজন লিখতে পারেন তাদেরকেও থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সত্য প্রকাশের কারণে আমাকে নিয়েও কিছু মহল মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, অনেকবার হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। তখন পাশে খুব কম সংখ্যক লোককে পেয়েছি, তাই বাধ্য হয়ে নীরব ভূমিকা পালন করতে হয়। যার কারণে সমাজে হাজারো অসংগতি দেখা দিলেও প্রতিবাদী লোক পাওয়া যায় না। ফলে সাধারণ জনগণ থেকে যাচ্ছে অসচেতন এবং সমাজে ঘটে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। আর এ অপসংস্কৃতির শিকার হন সমাজের উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। তাদের জীবনযাত্রা দেখলেই এর প্রভাব খুব সহজেই অনুমান করা যায়। সমাজ থেকে ভদ্রতা, নম্রতা যেন উঠেই গেছে। মান্যতা তো নেই বললেই চলে।

জীবনের প্রথম ধাক্কা খাই, যখন আমি ইন্টারে পড়ি। প্রথম মাদকের সংবাদ প্রকাশ করার জন্য, ক্ষমা চেয়ে বিষয়টির সমাধান করতে হয়। দ্বিতীয়টি সমাজের ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে, তারপর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার ফলে মিথ্যা মামলার আসামি হতে হয়। তারপর দীর্ঘ তিন বছর মণিপুরি মুসলিম সমাজ নিয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দীর্ঘ নীরবতার পর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আবার কলম ধরি, কিন্তু কিছু কিছু লোক পিছনে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে, তাদের আঁতে ঘা লেগেছে। এই সমাজ নিয়ে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল, প্রতিবাদী সাংবাদিক ও লেখক তৈরি করার, কিন্তু ওরা করতে দেবে না। যখনই লেখকদের সংগঠন গড়তে এগিয়ে যাই, সরাসরি বাধা দেয়। জানি না আমার এই ইচ্ছা কবে পূরণ হবে ।

কোনো রকম রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই শুধু আমার নিরন্তর পরিশ্রমের কারণে স্বার্থান্ধ হয়েও সমাজের কিছু ব্যতিক্রমী নেতার সহযোগিতায় আমি আজও সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করে যাচ্ছি। আমার নেই কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা, তবুও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের আদর্শকে আমি সমুন্নত রাখি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যমে মূল্যবোধ সম্পন্ন ও যুক্তিনির্ভর একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখি।

এ দেশে দর্শকনন্দিত টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায়শই বিভিন্ন রিপোর্টিং-এ সনাতন ধর্মীয়নৃত্য ও ধর্মাচারকে মণিপুরি নৃত্য ও লোকাচার হিসেবে প্রদর্শিত হয়। অথচ এ দেশে ১২ হাজারেরও অধিক মণিপুরি মুসলিম থাকা সত্ত্বেও তাদের জীবনাচার যাপন, সংগ্রামী ভূমিকা বা লোকাচার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। মণিপুরি মুসলিমরা মানবেতর জীবনযাপন করছে তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা বা দায়িত্ব নেই।

অথচ সনাতনধর্মী মণিপুরিদের জীবনাচার ও ধর্মাচারকে মণিপুরি সংস্কৃতি হিসেবে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। সনাতনধর্মী মণিপুরিদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম খবরের কাগজে গুরুত্বের সাথে স্থান পেলেও মণিপুরি মুসলমানদের কোনো কার্যক্রম গণমাধ্যমে তেমন একটা স্থান পায় না।

দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে সাংবাদিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রচার নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মতামত প্রতিফলিত হয় এরকম প্রতিবেদন প্রচার করা উচিত। গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা বাঙালিসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি মণিপুরি মুসলমানদের নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে প্রত্যাশা রাখি ।

দেশের প্রথম ইসলামী ঘরানার অনলাইন পত্রিকা ইনসাফ ডটকমের আয়োজনে ‘মিডিয়ার প্রয়োজন ও গুরুত্ব শীর্ষক’ আলোচনা দেখে মনে অনুপ্রেরণা জন্মায়। সেখানে বক্তারা ইসলামি মিডিয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করে, তখন মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত ও সহীহ্ মাসআলা মাসায়েল পৌঁছে দিতে পারি। বর্তমানে শক্তিশালী ইসলামি মিডিয়া না থাকার কারণে আমরা সেগুলো যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি না।

আমার ভাবনা মণিপুরি মুসলিম সমাজের আলেমরা সম্মানিত, তাদের দেখানো পথে সমাজের পথচলা। মণিপুরি মুসলিম সমাজে অনেক উলামায়ে কেরাম থাকা সত্যেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বর্তমানে আলেমরা অনেকে ফেসবুক ব্যবহার করে। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত ও সহীহ্ মাসআলা মাসায়েল পৌঁছে দিতে পারি ।

দীর্ঘদিন ধরে আমি মিডিয়া সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ইসলাম প্রচারে আলেমদের সাথে থাকতে চাই। আমার সেই ইচ্ছা আলেম সমাজ এগিয়ে আসলে তা পূর্ণ হবে। অনেকে জানে ২০১৬-১৭ সনে ইসলামিক অনলাইনে সবুজ বাংলা ব্লগ নিয়মিত ব্লগার ছিল, সেটি বর্তমান বন্ধ। সামু ব্লগে ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার পর কর্তৃপক্ষ ব্লক করেন। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার পথচলা।

গণমাধ্যমের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কথা বলা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখপত্র হিসেবে কাজ করা। সংবাদপত্রের এমন একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হওয়া আবশ্যক যা কারও ক্ষতির কারণ হবে না বরং মানুষের কল্যাণে তা নিবেদিত হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য গণমাধ্যম কাজ করতে পারে।

বস্তুনিষ্ঠ, সুষ্ঠু এবং সত্য সংবাদ প্রকাশ করে সমাজ, রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবে মিডিয়া। তার দায়িত্ব অনেক। দুর্নীতিকে না, মাদককে না, ধূমপানকে না বলতে গণমাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন গণমাধ্যম বা মিডিয়া।

মণিপুরি মুসলিমদের বর্তমানে শক্তিশালী একটি মিডিয়া না থাকার কারণে আমরা সেগুলো যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। সুতরাং আমাদের নিজস্ব মিডিয়া না থাকার কারণে আমরা আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা ও চেতনাভিত্তিক কর্মকাণ্ড মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারছি না।

মণিপুরি মুসলমানদের মানুষের সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে ও সভ্যতা বিকাশে গণমাধ্যম ভূমিকা রয়েছে, যা আমাদের নিজেদের মধ্যেই গণমাধ্যমকর্মী ও লেখকরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। ফলে গণমাধ্যমে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়গুলো দ্রুত প্রচার করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড